আঁকা - কল্যাণী রমা

'আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে'

আজ ১০ই অক্টোবর। অবিনের জন্মদিন। হ্যাঁ, ওর জন্মদিনটাই মনে রাখতে চাই। মৃত্যুদিনটা নয়। কত কষ্ট পেয়ে, নিউইয়র্কের হাসপাতাল থেকে কিছুদিন আগে ও আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেল! দিপানভাই নিউইয়র্ক থেকে এই করোনা সময়ে ওর জানাজার ভিডিও পাঠালেন আমাকে। দু' চোখ খুলে রেখে, চোখের জলের বন্যায় না ভেসে গিয়ে সে কি দেখা যায়

মৃত্যুর ছবি না মনে রেখে আমি মনে রাখতে চাই ছেলেবেলার প্রতিটি ১০ই অক্টোবরের কথা। হোস্নেয়ারা মাসির বানানো কেক। কখনো কখনো গুড়, আর আদা দিয়ে বানানো অসাধারণ জিঞ্জার কেকও সেখানে ছিল কি? ছিল না ছোট ছোট কাপে দেওয়া কফি? আমাদের বাড়িতে ছোটদের চা, কফি খাওয়া নিষেধ ছিল। আরো কত কীই যে নিষেধ ছিল। নিষেধ ছিল ভাজাভুজি খাওয়া। হোস্নেয়ারা মাসির বাসায় আমরা পেতাম সব মুখরোচক খাবার। জন্মদিনগুলো ছিল লোভনীয় এক একটা স্মরণীয়  ঘটনা। 

 অবিন আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু সুস্মির ছোটভাই। সত্যিকার অর্থে, রক্ত মিলিয়ে আমাদের কোন ভাই ছিল না। আমরা দুই বোন। কিন্তু রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে বেড়ে উঠবার সময় আমাদের ছিল অবিন, শমী, আমান। নিচের ছবিটায় দেখি অবিনকে ভাইফোঁটা দিচ্ছি আমরা। 

 

ভাইফোঁটা

এ ছবিটা খুব প্রিয় আমার। কোন রকম সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতার
 
ঝান্ডা না উড়িয়েও, ঢাক-ঢোল না পিটিয়েও খুব স্বাভাবিকভাবেই ছবিটা  বড় বেশি অসাম্প্রদায়িক। বড় বেশি সাধ হয় আজকের বাংলাদেশের ছবিটা এমন হোক। এ ছবিতে আমার দাদুভাই-এর পাশে অবিন ফোঁটা নেওয়ার জন্য বসে আছে।  ফোঁটা দিতে উপস্থিত আমার খাতা-কলমে মুসলিম বন্ধু  শাওন, সুস্মি।  ছবিটা দেখে অবিন চলে যাওয়ার পর শাওন বলেছিল, ' যমের দুয়ারে কাঁটা আমরা দিতে পারলাম না। ভাইফোঁটা দিয়েও অবিনকে আমরা রাখতে পারলাম না।' হ্যাঁ, অকালে অবিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে কঠিন অসুখে।  অবিন চলে যাওয়ার পর হোস্নেয়ারা মাসি আমায় বারবার বলেছেন, 'আমি কেমন মা? আমার আয়ুর বদলে কেন আমার ছেলেটা থাকল না?' কী জানি মৃত্যুর দাঁড়িপাল্লায় হিসাব বুঝি সেভাবে হয় না।  

এই সেদিন সুস্মি আমায় বলছিল, 'অবিন ওর ঢাকা বাসায় গোল্ডেন রিট্রিভার বা ল্যাব্রাডার রিট্রিভার পুষতে চেয়েছিল।আমি তো যে উটকো, চিরদিনই যারা কুকুর পোষে বা পুষতে চায়, তাদের মহামানব বলে মনে হয়। অবিনের এ ইচ্ছার কথা শুনে আমি যথারীতি ভীষণ আপ্লুত হয়ে গেলাম।  ওর মাথায় আর একটা ময়ূর পালক গুঁজে দিলাম।  

অবিনের নানা গুণের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুণ ছিল ও ছিল অসম্ভব উইটি। ওর সাথে থাকলে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি না দিয়ে উপায় থাকত না। একবার সন্ধ্যায় আমি আর অবিন বেগম রোকেয়া হলের পিছনে হাঁটছি। লুসিদের বাড়ির সামনে বিরাট পুকুরটার পাশ দিয়ে।  পুকুরটা থেকে শ্যাওলার সোঁদা গন্ধ ভেসে আসছে। কোণায় কোণায় শাপলা ফুটে আছে। বড় চাঁদ উঠেছে। ভীষণ মর্মান্তিক সুন্দর পরিবেশ। আমায় আর পায় কে? বেসুরো গলায় গান ধরলাম-

'আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে

বসন্তের বাতাসটুকুর মতো...'

অবিন আমায় বলল, ' রমা আপা, গানটা না'হয় থাক!'

হাসতে হাসতে মরে যাই আমি। কথা সত্য। জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ - কোন কাজেই পিছুপা নই আমি।  সবকিছুতে অংশগ্রহণ করা আমার চাই-ই চাই।  কিন্তু গানটা সত্যিই থাক! 

 অবিনের অবস্থা খুব খারাপ হচ্ছে শুনে আমি ওর জন্য একটা হলুদ রঙের গোলাপ গাছ কিনে এনেছিলাম। 


অবিনের জন্য এই হলুদ গোলাপ গাছটা লাগিয়েছিলাম

হিমশীতল উইস্কনসিনে খুব বেশি গোলাপ হয় না। এত আর গোলাপের শহর পোর্টল্যান্ড নয়! আমি তো সবসময় বলি পোর্টল্যান্ডের গোলাপ বাঁধাকপি আর উইস্কনসিনের গোলাপ ব্রাসেল স্প্রাউট! শুনেছি হলুদ গোলাপ খুব প্রিয় মানুষকে হারানোর বেদনায় লাগাতে হয়।  আমাকে সবাই বলল অবিনের লাইফ সাপোর্ট  নিউইয়র্ক সময় বারোটায় খুলে দেবে। এই করোনা সময়ে ওয়ার্ক ফ্রম হোম শুরু হয়ে যাবে বলে আমি সকাল সকাল উঠে সাড়ে আটটার দিকে অবিনের কথা ভেবে আমার হলুদ গোলাপ গাছ লাগাতে শুরু করলাম। পরে শুনি অবিনের অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় ওর লাইফ সাপোর্ট সকাল সাড়ে আটটার দিকেই খুলে দিতে হয়েছে।  আমি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করি না।  তবু এ ঘটনায় মনে হ'  ওর প্রাণের অংশ কি হলুদ গোলাপ হয়ে ফুটলআরো আশ্চর্য আজ দেখি অবিনের জন্মদিনে একটা হলুদ গোলাপ ফুটেছে।  অক্টোবর মাসে কবে উইস্কনসিনে গোলাপফুল ফুটেছিলযখন সব হারিয়ে যায়কত বিশ্বাস যে আমরা আঁকড়ে ধরি।  

আজ ১০ই অক্টোবর অবিনের জন্মদিনে এই গোলাপটা ফুটেছে


গলার কাছটা বুঁজে আসছে। কোন কথাই বলতে পারছি না। আমার ভাঙা গলায় একটা গানই শুধু মনে আসছে।

'আমার প্রাণের 'পরে চলে গেল কে
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো
সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে-
ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত
সে চলে গেল, বলে গেল না-
সে কোথায় গেল ফিরে এল না
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল
কী যেন গেয়ে গেল-
তাই আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে 
সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে- 
চাঁদের আলোর দেশে গেছে
যেখান দিয়ে হেসে গেছে
হাসি তার রেখে গেছে রে-' 

আমি জানি আজ অবিন আমায় কিছুতেই বলত না, ' রমা আপা, গানটা না হয় থাক!'

মন্তব্যসমূহ

  1. রমার সাথে আমার দেখা হয়নি তবে সুস্মি,কুসুম,স্বপ্নার কাছে গল্প শুনে, লেখা পড়ে একটা ছবি তৈরি হোয়েছে। আজ সকালে মর্মস্পর্শী এ লেখাটা পড়ে অবিনের জন্য মনটা আবার কেঁদে উঠল।অবিন বেঁচে আছে সবার মধ্যে। অকাল্প্রয়াত এ ফুলটি সুবাস ছড়াক গোলাপ হোয়ে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন



কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বইঃ
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।