আঁকা - কল্যাণী রমা

মম্‌, আই ডু নট নীড ইউ এনিমোর


~কল্যাণী রমা


[হৈ, তাথৈ অস্‌কস্‌ গেছে সাইন্স অলিম্পিয়াডে। প্রথমবারের মত দু’জনই উধাও। দিনে থাকবে না। রাতে থাকবে না। বাড়ি এত ফাঁকা। ভাবছি পাখির বাসা থেকে ডানা ঝাপটে ছানাগুলো উড়ে গেলে পাখি মায়ের-ও এমনই বুঝি লাগে...

কেবল মনে হচ্ছে কিছুই বুঝি আর করবার দরকার নেই। কষানো মুরগীর মাংস রেঁধেই বা কী আর লাভ। অকাজের কাজ কম্পিউটারের মেইলবক্স খালি করতে গিয়ে বহুদিন আগে লেখা নীচের কথাগুলো খুঁজে পেলাম। বুকে পাওয়ার রেঞ্জার আঁকা, হলুদ রঙের প্রিয় জামা পরা ছবিটা পাঁচ বছুরে হৈ-এর। প্রথম দিন স্কুলে যাওয়ার। ভয়, ভয় মুখ। যদিও মনের ভিতর বীর, বীর ভাব।

মিলেনিয়াম বেবী ব’লে কখনও এই ছানাটার বয়স আবিষ্কার করতে গিয়ে নানা রকম যোগ বিয়োগের কুস্তি ক’রে, মানসাঙ্কের পান্ডিত্য ফলাতে হ’য় না আমার। ১৪ বছর বয়স এখন হৈ-এর। প্রায় ছয় ফুট লম্বা হয়েছে, বাবা-কে ছাড়িয়ে গেছে। এ বছরই হাইস্কুলে যাবে ও।

২৮শে মার্চ, শুক্রবার, ২০১৪
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন]









যখন কারোর জীবনেই স্কুল নামক জঞ্জাল ছিল না। সব ছবিতেই তখন পরী হ’য়ে উড়ে যাওয়া তাথৈ-এর পা মাটিতে থাকত না। সবাই কাগজের মুকুট পড়ে রাজা!



মাম-কে নাচ দেখাচ্ছে হৈ, তাথৈ 


৬ই সেপ্টেম্বর, ২০০৫

স্টউটন, উইস্কনসিন

গত কিছুদিন ধরে কতবার যে দোকানে যাচ্ছি! স্কুলের সাপ্লাই লিস্ট মিলিয়ে মিলিয়ে 5.8 X 2.5 X 1.5 সাইজের পেন্সিল বক্স, আর্ট স্মক, ক্রেঅন, নাম্বার টু পেন্সিল, উডেন রুলার, টু-পকেট ফোল্ডার, স্পাইডারম্যান ব্যাকপ্যাক...কত কী যে ছোট ছোট জিনিষ আর তা কিনবার জন্য আমার কত দোকান যে শুধু শুধুই ঘোরা। যদিও পছন্দসই আর্ট স্মক আর টু-পকেট ফোল্ডার খুঁজে পাওয়া গেল না। এই বিদেশ বিভুঁই-এ আত্মীয়ের চেয়েও বেশি, সবসময় সাহায্য করবার জন্য চার হাত পা বাড়িয়ে রাখা স্টিভ আর ডেবরা এগিয়ে এল। স্টিভ ওর সাইজের একটা শাদা টি-শার্ট দিয়ে বলল, ‘এটা খুব ভালো আর্ট স্মক হ’বে।’ যথারীতি আমার তা বড় বেশি সাদামাটা মনে হ’ল ব’লে আমি তার উপর নানা চিত্র বিচিত্র ছবি এঁকে টি-শার্টকে আর্ট স্মকের জাতে তুলে দিলাম। ডেবরা দৌড়ে গিয়ে ওর ঘর থেকে টু-পকেট ফোল্ডার নিয়ে এ’ল। আসলে ও তো স্কুলে পড়ায়। টু-পকেট ফোল্ডারের মানে একদম নাম শোনামাত্র সাথে সাথে বুঝতে পারল। আমি তো কোনদিন স্কুলে পড়াই নি! এদেশে স্কুলে পড়ি নি! তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কিছুই বুঝতে পারি নি।

অবশেষে লেবার ডে-র পরের দিন এসেই গেল। সামারে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে বাড়ির মাঠময় দৌড়াদৌড়ি...সেই মাঠেই কাঁথা দিয়ে তাঁবু খাটিয়ে পিকনিক পিকনিক খেলা...আমার দিদার শাড়ি দিয়ে বানানো এইসব কাঁথা...হৈ তাথৈ-এর ছোট ছোট নিজস্ব বাগানে সূর্যমুখি আর শশা লাগানো...ম্যাগ্‌নোলিয়া গাছে প্রজাপতি হ’বে ব’লে ক্যাটারপিলারগুলো প্রতিদিন কত যে বড় হচ্ছে তা মেজারিং টেপ দিয়ে মাপা...আর গাছের নিচে পা ছড়িয়ে দুই বাচ্চা আর দুই কুকুরকে ‘দ্যা ভেরী হাংগ্‌রি ক্যাটারপিলার’ বই পড়ে শোনানো – সব সব শেষ। 


 মাঠে আমাদের তাঁবু – দিদার শাড়ি দিয়ে বানানো কাঁথায় দোতলা ছাদ...হৈ তাথৈ ঘুমের ভান করছে



একটু গ্রামের দিকে থাকি ব’লে সকাল ৮টায় স্কুল হ’লেও বাস আসবে ছয়টা পঞ্চাশে। ঘন্টা খানেক গ্রামের পথে ঘুরবে আমার হৈ। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ সব স্কুলে করবে। ফুল ডে কিন্ডারগার্টেনের জন্য লিস্ট মিলিয়ে সাথে লাল, নীল রঙ্গের ফোল্ড ক’রা স্লিপিং ম্যাট দিয়েছি, সেখানেই সে নাকি দুপুরে ন্যাপ নেবে, আর ফিরবে সেই বিকেলে...

তা সে গত দুই দিন থেকেই একটু পর পর ফ্যাচ ফ্যাচ ক’রে চলেছি আমি। কাল রাতে দেশে ও এখানে সকলকে ফোন ক’রে আশির্বাদ নিয়ে ফেললাম। এমনি নাকি ভারি নাস্তিক, ঠাকুর দেবতা আবার কি? কোনো পূজার পাটও নেই বাড়িতে। তবু চুপি চুপি ঘর সাজানোর গণেশ আর বুদ্ধ মূর্তিকেই একটু প্রণাম ক’রে এলাম। মনে মনে দিদার কাছে শোনা সেই কথাটা আউড়ে ভারি শান্তি পেলাম,‘মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা!’

এবং শেষ পর্যন্ত সত্যিই স্কুল বাস মাথার উপরে ঝিলমিলে আলো জ্বালাতে জ্বালাতে সময় মত এসে গেল। টংসা সিম্বা দুই কুকুর, বাবা মা সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ছেলেকে তুলে দিতে। ছোট বোন তাথৈ যদিও ঘুম থেকে উঠতে পারে নি।





প্রথম দিন – পাঁচ বছরের হৈ স্কুলে যাচ্ছে


প্রথম স্কুলে যাচ্ছে ব’লে হৈ-কে ড্রাইভারের ঠিক পিছনের সীটেই বসতে হ’বে। কিন্ডারগার্টেনেরই
আর একটা ছোট ছেলে ওর পাশে। যথারীতি চিরকালের অকারণেই ভারি চিন্তিত হওয়া মন নিয়ে,
ভারি উঁকি ঝুঁকি দিয়ে আমি বাসের ভিতরটা কতটা সেফ দেখতে থাকলাম। বেল্ট আছে কি? একা বাঁধতে পারবে তো? গলায় বড় ক’রে ট্যাগ ঝোলানো আছে হৈ-এর, তাতে লেখা আছে নাম, কোন রাউটের বাস - সব। তবুও যদি...কিংবা..।

আমার কান্ড কারখানা দেখে ড্রাইভার অবশেষে আশ্বাস দিয়ে বলেই ফেললেন, ‘ডোন্ট ওয়ারি, উই হ্যাভ গট হিম!’ শেষ মুহুর্তের উপদেশ হিসাবে ওর ‘বা’-ও বলে ফেলল, ‘শোনো, এখন তো রাস্তার এই পাশ থেকে উঠছো, যখন ফিরবে তখন রাস্তার ওই পাশে ডেবরাদের বাড়ির সামনে বাস থামবে কিন্তু। মম্‌ থাকবে, তবু চারদিক দেখে রাস্তা ক্রস করো।’ 

ওমা, কী কান্ড! ছেলে ব’লে উঠল, ‘মম্‌, এ্যাকচুয়ালি আই ডোন্ট নীড ইউ এনি মোর।’


লাল ছবি তুলতে থাকল, টংসা সিম্বা মহা ভৌ ভৌ দিতে থাকল, আমি ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে
থাকলাম, আর আমার ছোট্ট হৈ হলদে বাসে ক’রে স্কুলে চ’লে গেল...





মন্তব্যসমূহ



কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বইঃ
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।