হাউ টু টাই অ্যা টাই
~কল্যাণী রমা
ফোনে বান্ধবী সুস্মিতা বলল, ‘কি রে তুলে দিয়ে
এলি? ও মাই গস্! কাঁদছিস্? আর কাঁদবি নাই বা কেন? তুই তো প্রজাপতি উড়ে গেলেও
কাঁদিস।’
হৈ-কে এই তুলে দিয়ে এলাম। রবিবার সকাল সাতটা। ভোরবেলা। বাসে ক’রে মিলওয়াকি
যাবে। সেখান থেকে প্লেনে ওয়াশিংটন ডিসি। এই স্কুল ছেড়ে যাওয়ার আগে ক্লাশ এইটের সবাই
মিলে শিক্ষকদের সাথে এক সপ্তাহের জন্য শিক্ষা সফর। খুব অল্প ছেলেমেয়ে হৈ-দের
ক্লাশে। তিন সেকসন মিলিয়ে তিরিশজন। হৈ-এর সেকশনে দশজন। তবু এই কয়জনকে নিয়েই বড়
শহরে হারিয়ে যাওয়া তো যেতেই পারে! খুব শৃংখলার মধ্যে জীবন না কাটালে আগডুম বাগডুম যা
কিছুই হওয়া সম্ভব।
প্রিন্সিপাল বলে দিয়েছেন, ‘বাস আটটা-তে ছাড়বে। আটটা
পাঁচে নয়। যদি আটটা পাঁচ হ’য়ে যায়, তবে আর স্কুলে আসবার প্রয়োজন নেই। বাবা মা-কে
নিয়ে সোজা মিলওয়াকি চলে গেলেই হ’বে।’ মিলওয়াকি ম্যাডিসন থেকে একশ’ সাতাশ কিলোমিটার
দূরে। হুমকিটার গুরত্ব এবং গাম্ভীর্য বিবেচনা করে সব বাবা, মা-ই আমাদের
মত পাঁচ ঘরে পাঁচটা এলার্ম দিয়েছিল কিনা কে জানে। তবে রবিবারের সকালে সবাই ঘুম ভেঙ্গে
উঠেছে এবং জোড়ো হয়েছে ‘ঈগল স্কুল অফ্ ম্যাডিসন’-এর
সামনে।
উপস্থিত ড্যাসার, ড্যান্সার, প্র্যান্সার,
ভিক্সেন, কমেট, কিউপিড, ডোনার, ব্লিটজেন এবং অবশ্যই রেড নোজ রুডলফ্।তবে কে যে আসল রুডলফ বোঝা ভীষণ শক্ত। নিজ ছানাকে নিয়ে সব মা বাবারই তো মনে মনে গুন্গুন্,
‘...do you recall the most
famous reindeer of all…’
আজকাল সন্তান-সন্ততি নিয়ে এত্ত মুশকিল্! চাই
চাই চাই। ব্র্যান্ডনেমড জামা চাই, আইপড চাই, আইপ্যাড চাই, ফোর জি ফোন চাই।
বন্ধুদের আছে। আহা, টঙ্কা তো আর আপেল নয়। গাছে ধরে আছে। আর বাবা মা? আইস হকি শেখাতে নিয়ে চলল। হার্প। সবাই যেন মল্লযুদ্ধটা শিখে ফেলে। বন্ধ ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই সব নকল রক ক্লাইম্ব
করতেই হ’বে। শেখাতে না নিয়ে গেলেও তো মুশকিল। পিছিয়ে পড়বে। কার পিছনে কে পড়বে? কেই বা
সামনে? সামনেটাই বা কি?
মনে পড়ল খুব ছেলেবেলায় পড়া ভালেন্তিনা
ওসেয়েভা-র লেখা ‘নীল পাতা’ বইটার কথা। ‘ছেলেরা’। কুয়ো থেকে জল তুলছে তিন গিন্নি।
থুত্থুরে এক বুড়ো জিরতে বসে আছে কাছেই।
পাথরের উপর। হঠাত্ ছুটে আসে তিনটি ছেলে। একজন হাতে ভর দিয়ে বনবন করে ডিগবাজি খায়।
অন্য ছেলেটা গান ধরে। যেন কোকিল গাইছে। তিন নাম্বার ছেলেটা এসে মায়ের হাত থেকে
ভারি বালতিটা নিয়ে নিজেই বইতে থাকে। বুড়োকে গিন্নিদের প্রশ্নঃ ‘তা কেমন দেখলেন
আমাদের ছেলেদের?’‘ছেলেরা আবার কোথায়? – জবাব দেয় বুড়ো, - আমি
তো কেবল একটি ছেলেকে দেখছি।’
ছুটির দিনে সকালে ঘুম থেকে
উঠেই শুরু হ’য়ে যায় টিম ফোট্রেস টু। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চলছে সেই একই ভিডিও
গেম। দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে সত্যিকারের কথা না ব’লে ‘LOL’
ল্যাংগোয়েজে টেক্সট করে চলেছে। কিংবা মা বাবার সাথে বলছে টীন এজ বয়সের ভাষা মিশরীয়
“হাইরোগ্লিফিকস্”। ঘরের দরজাটা খুললেই যে
সত্যিকারের আমগাছটা দাঁড়িয়ে আছে, তা থেকে ঝাপিয়ে পড়ে ‘ঝাই ঝাপ্পা কানাই মাছি’
খেলবার দিন শেষ। আর মালবেরী গাছে চড়ে বেগুনী জামা, বেগুনী মুখ? মা বাবার স্মৃতির
শৈশব!
প্রায়
একমাসের উপর কী হুলস্থুলই না চলছে। ড্রেস প্যান্ট, ড্রেস শার্ট, ফরমাল স্যুট,
সেমাই ফরমাল, ক্যাজুয়াল – হট্টগোলের চূড়ান্ত। একজন মা আবার খবর দিল, সে নাকি খ্রীস্টমাসের
সময় সেলে মেয়ের জন্য স্যুট কিনেছে। প্রায় অর্ধেক দামে পেয়েছে। কিন্তু আমার তো সবসময়ই ট্রেন ফেল! বাবার-ও মোটামুটি ফেল ফেল অবস্থা। আগে
টাই বাঁধা শেখানো হয় নি। যাওয়ার আগের দিন রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেকে নিয়ে লাফঝাঁপ। টাই-এর লেজ উঠছে, নামছে। Seesaw। এদিকে জামাকাপড়ের পাতাবাহার দেখেও বোঝা মুশ্কিল।
এরা সিনেটরদের সাথে দেখা করবে নাকি নিজেরাই সিনেটর হ’বে! পাবলিক এপিয়ারেন্স দিতে
গিয়ে যেন কোনরকম ‘ক্লজেট ম্যালফাংক্শন’ না হ’য়ে যায়। রাজধানী ব’লে কথা। তার উপর আবার আকাশের মেঘের
সাথে পাল্লা দিয়ে চেরীফুল ফুটছে।
আমি
এত্ত নার্ভাস! অত্যাচারে অতিষ্ট হ’য়ে হৈ তো বলেই দিল,‘মম্, ইউ আর সাফারিং ফ্রম
এমটি নেস্ট সিন্ড্রম্! গেট ইউজড্ টু ইট। সুন আই উইল বি অফ্ টু কলেজ!’
আমার
এও যত্ন! গুঁজে দিলাম দু’টো টুথব্রাশ। এমন নয় যে দুই ব্যাগে। একটা হারালে আর একটা
পাবে। সব এক পকেটেই ধাক্কাধাক্কি।
‘ম-ম্,
আই হ্যাভ জাস্ট ওয়ান মাউথ!’
মোটামুটি সকলেরই বাবা মা দু’জনই উপস্থিত। শুধু একজন বীর সেনানী অন্য বন্ধুর বাবা মা-র
সাথে কারপুল ক’রে এসেছে।বেশির
ভাগ বাচ্চাই এই প্রথম বাবা মাকে ছেড়ে এক সপ্তাহের জন্য একা বাইরে কোথাও যাচ্ছে। একজন
মা যদিও বলল তার ছেলে নাকি গত সামারে একাই তিন সপ্তাহের জন্য ইউরোপ ঘুরতে
গিয়েছিলো। বুঝতে পারলাম এখানেও আমি লেজে গোবরে, ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা! ট্রেনিংটা
ঠিক হয়নি। ছানাদের নিয়ে এখনও শুধু আকুলি বিকুলি মাম্মা। যাওয়ার আগে বিদায়ী হাগ দিতে গেলাম। ছানা আমার
মুরগীর মত দু’পাশে ডানা মেলে দাঁড়িয়ে থাকল। জনসমক্ষে টিন এজ বাচ্চারা এমনিই ক’রে।
অথচ
যখন আমি ক্লাশ ফাইভে পড়ি আর ছোটবোন ক্লাশ টু-তে, ঠিক হ’ল মা-কে দেখতে ইংল্যান্ড
যাব। ঢাকার তেজগাঁ এয়ারপোর্ট
থেকে তুলে দেওয়া হ’ল। হিথ্রো-তে নামিয়ে নেবে মা। দেখে ফেললাম বাকিংহাম প্যালেস,
গার্ড চেঞ্জ, প্ল্যানেটোরিয়াম, মাদাম ত্যুসো, ইংলিশ চ্যানেল, টেমস্ নদী, টাওয়ার
অফ্ লন্ডন, শেক্সপিয়ারের বাড়ি কত কী। তুলনাহীন
অভিজ্ঞতা। আর ছোট দু’টো মানুষ একা একা ‘বিলাত ভ্রমণে’ বের হয়েছে বলে
এয়ারহোস্টেসদের কী যত্ন, কী যত্ন। কী ভালোই যে লেগে গেল ওদের। কিন্তু এ কি? শাদা
মুখ, কালো পা? পরে কে যেন বলল ওরা কালো টাইটস্ পড়েছে। সেই কবেকার কথা! কিন্তু এমনই
বিস্ময়ের ঘোর লেগেছিল যে আজও এই গল্পটা মনে আছে।
আর
ক্লাশ সেভেন, এইট থেকে সেইসব ক্যাম্পের কথা? আমি রাজশাহী, ঢাকা যাওয়ার চান্স
পেয়েছিলাম গার্ল গাইডস থেকে, রেড-ক্রস থেকে। গোপন খবর হ’ল আমাদের বাড়ির কড়া শাসনের
পাল্লায় পড়ে স্বাধীন, উড়ন্ত বলাকা সুস্মিতার মত সিলেট, চিটাগাং যাওয়ার চান্স পাওয়া
যায় নি!
একবার
মাদার তেরেসা ঢাকায় এসেছেন।
আমি রেডক্রস ক্যাম্পে। নিজের গায়ে আগুন না ধরিয়ে কী যেন একটা ডিম পেড়েছি না ডিম
ওমলেট করেছি। পেয়ে ফেল্লাম মাদার তেরেসার হাত থেকে মেডেল। আজও সে মেডেল
ফায়ার-প্লেসের উপর থেকে স্বপ্নের ভিতর ঝুলিয়ে রেখেছি।
রাজশাহীতে
গার্ল গাইডস ক্যাম্প। আমরা ভালো ব্যাং ভাজতে পারি, আমরা ভালো ব্যাং-এর মত গলা
সাধতে পারি, আমরা ভালো ব্যাং-এর মত লাফ দিতে পারি। এতই যে সব ভালো পারি, আমাদের দেখিয়ে আমাদের
লাফ ঝাঁপ কে নিজের দেওয়া শিক্ষা বলে শেষমেষ আমাদের গাইড আপা অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। আমরা
ব্যাং বাবাজীবন সব কূয়ার মধ্যে থেকে গেলাম। সে দুঃখের কথা নিঃশব্দে বুকে চেপে
রাখাই ভালো। ‘গাইড দীপটি নিভাতে চাই, নিভাতে চাই।’
আর
একবার। পি এন স্কুলে ক্যাম্প। টান্ টান্ তাঁবু টানানো হয়েছে। খবরের কাগজ বুনে
বুনে মাটিতে বসবার ম্যাট ‘সীট-আপন’, রীফনট্, ফিশারম্যানস্ নট, রূপসী ফিগার এইট নট্ সব হাতে কলমে
শেখা শেষ। রাত হ’য়ে গেছে। টেন্টের মেঝেময় খড় বিছানো। তার উপর নিজ নিজ হোল্ড-অল পেতে
আমাদের বিছানা। হোল্ড-অল খুলতে গেছি, ‘ফোঁস’!
ফনা তুলে গোখরা। খড়ের নীচ থেকে। বেচারা শান্তিতে
ঘুমাচ্ছিল। মাথায় খড়ম আঁকা।
‘কাট্, কাট্’, বান্ধবী
সুস্মিতা এসে গেছে!
‘সব সবসময় গুল মারিস্ কেন? মোটেই গোখরা ছিল না। তুই নিজ
চোখে খড়ম দেখেছিস্?’
‘বাহ্ রে! তাও তো পাইথন বলি নি। শোন্, গুল বলে কোন কথা নেই। কথা যখন বলবি সবসময় একটু সুন্দর করে, রঙ্গিন ক’রে বলবি যেন যারা শুনছে তাদের মনে হয়
বিরিয়ানী খাচ্ছে! মাথায় দোলনচাঁপা দিয়ে যখন সাজিস্, তোর ভালো লাগে। অন্যদেরও ভালো লাগে। দেখ্ না যেমন আমি সবসময় বলে থাকি
টিসাকে স্কুলের পিকনিকে চিড়িয়াখানায় বানর কামড়ে দিয়েছিল। আসলে নাকি গরাদের ফাঁক
দিয়ে বানর আঁচড় মেরেছিল।’
যাহোক, সে রাতে আর
টর্চ নিয়ে কেউ গোখরা বা পাইথন দেখতে গেল না। আমাদের টেন্টে শুতে দিল না।
সোজা স্কুলঘরের মাটি।
বন্ধুগণ,
এইসব অতীত কাহিনীর আরব্য রজনীর গল্প বলবার একটাই কারণ। তখনকার স্ট্যান্ডার্ডে অনেক
পুতুপুতু ক’রে আমরা বড় হলেও ছেলেবেলায় এইসব ছোটাখাট এভারেষ্ট জয় করতে আমাদের বাবা
মা কিন্তু দিয়েছিল। মে মাসে চোদ্দ বছর হ'বে হৈ-এর। তবে আমার কেন এই চরম দুরাবস্থা? শুধু আমাদের ছানাপোনাই আমাদের
রক্তের সন্তান?
যাওয়ার
আগে হৈ-এর প্রিয়তম বন্ধুর মা বলল, ‘এতগুলো টাকা হাতখরচ আর লাঞ্চ কিনবার জন্য দেব।
একঘন্টার মধ্যে তো নিকোলাস সব হারিয়ে ফেলবে। একদম সম্ভব। উইস্কনসিনে কী বরফই না
পড়ে। প্রায় হাঁটুসমান। বহুদিন দেখেছি স্কুলে যাওয়ার সময় শীতকালেও নিকোলাস এসেছে
মোজা আর ক্লগ পড়ে। সমুদ্রসৈকত তো নয়! আসলে স্কুলের জুতা পড়তে ভুলে গেছে।
আমাদের হৈ-ও কম যায় না। নিজ
স্কুলের বাইরে বেশ বড়সর এক পরীক্ষা দিতে যাবে। বারবার বলেছি ক্যালকুলেটর-টা মনে ক’রে বাড়ি এন।
স্কুল কিন্তু সোমবার সকাল আটটার আগে খুলবে না। শনিবার পরীক্ষা।
যথারীতি। পরীক্ষার আগের দিন রাত বারোটায় জানা গেল ক্যালকুলেটার বাড়ি আসেননি।
‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী হ’য়ে তখন ক্যালকুলেটার কিনবার পালা! সকলের দাঁতে দাঁত ঘষা
বন্ধ হ’লে,
‘তা
কোথায় রেখে এসেছ ক্যালকুলেটারটা?’
‘স্কুলে,
জিম সুর নীচে। ভালো ক’রে চাপা দিয়েছি। খুব সেফ।’ শুনলেই তো আমার মা হার্টফেল করবে।
পড়াশোনার কোন জিনিষে জুতা ছুঁইয়েছ? আর আমি সেফটিনেটে সদ্য ধরা পড়া মাছের মত ছট্ফট্!ছোটবোন
তাথৈ এটা এগিয়ে দেয়, সেটা এগিয়ে দেয়। শেষমেষ কাঠি, গুলি দিয়ে একটা এ্যাবাকাস
বানিয়ে ধরিয়ে দেবে কিনা কে জানে। সব ভাই আর দাদাগুলোই বুঝি এমন বুদ্ধিমতী মাশার
ভাই!
স্কুলের
বই ভুলে স্কুলে এসে হাজির ভিতিয়া । ‘কী
হবে এখন? ঘন্টা পড়ে গেল...দরজা খোলে-খোলে...’ ‘ববিক, রবিক, লবিক, জুবিক!’ ডাক পড়ল চার
কুকুরের। তাদের মুখে বই খাতা গুঁজে
দিল বুদ্ধিমতী মাশা। কী দৌড়, কী দৌড়। দিদিমণি আসবার একটু আগেই বই খাতা নিয়ে এসে
হাজির কুকুরেরা। সাথে চিঠি। লেখা আছে, ‘তুই একটা ভুলো। তোর দিদি মাশা।’
কিন্তু
গল্প তো গল্পই। নিকোলাসের মা’র চিন্তার কথা হৈ-কে বলতেই ততক্ষণাত্, ‘নট টু ওয়ারি।
আই উইল স্ট্যান্ড বাই মাই ফ্রেন্ড!’ নিকোলাসের মা-কে সে কথা বলতেই হাসতে হাসতে,
‘নিশ্চয়!’
গাড়িতে
ক'রে স্কুলে যাওয়ার পথে হৈ-এর নানা গল্প। পরে স্কেজুল দেখে কোন কোন জায়গায় যাবে শুনে আর উইকিপিডিয়া উল্টে
জ্ঞান আমার আরো বেড়ে গেল।
ওরা জর্জটাউন হোটেলে
থাকবে। ওল্ড ইউরোপ রেস্টুরেন্ট, ইউনিয়ন
স্টেশন, ওল্ড টাউন আলেকসন্দ্রিয়া-তে ডানিয়েল ও’কনাল
রেস্টুরেন্ট, কাস্কেড কাফে, মিঃ স্মিথ্স
জর্জটাউন-এ খাওয়া দাওয়া। জিভে জল এল!
শোনা গেল আছে নাকি টোয়াইলাইট
ডিনার এন্ড ড্যান্স ক্রুজ। টোয়াইলাইটের আলোতে ড্যান্স করতে গিয়ে অজানা বনে বাবা ইয়াগা না
তাড়া ক’রে! সে নাচ জানে না।
‘আমরা হোয়াইট হাউজ দেখতে যাব।’ বাহ্! বোঝা গেল হোয়াইট হাউজ-এর লোহার
কালো বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবার সুযোগ পাবে। দেখে ফেলবে স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম, নিউজিয়াম, লিঙ্কন মিউজিয়াম। আলবার্ট আইনস্টাইন মিউজিয়াম-ও ।

আইনস্টাইনের
হাত। ব্রঞ্জের পুরো মূর্তিটার
ওজন ৪ টন। আইনস্টাইনের একশ’ বছরের জন্মদিনে উন্মোচন ক’রা হয় এই ১২ ফুট মূর্তি।
ন্যাশনাল ক্যাথিড্রালের লাল-নীল রঙ্গের দুইশ’ স্টেইন্ড্ গ্লাসের উইন্ডো দিয়ে
বাইরের পৃথিবীটা দেখবে। জানালায় স্বপ্নে আঁকা কাচের গোলাপ!
যাওয়া আছে
চায়না টাউনে। ইমিগ্রান্ট্দের গল্প সবসময় আমাকে এত মোহগ্রস্ত ক’রে! আমেরিকার
প্যাচওয়ার্ক কুইল্টে এক একটা স্কয়ার ওরা। শুধু তো নিজেরাই আসে নি। সাথে এসেছে
ইতিহাস, ঐতিহ্য, নিজ নিজ ঘরের রান্নাগুলো, ঠাকুরদাদার গল্প, নাচ, গান। ফেলে আসা কান্না
আর স্মৃতি। পাশের বাড়ির প্রিয় বন্ধু ডেবরা মাঝে মাঝেই আমাকে নানা রান্নার রেসিপি
দিত। সুইডিশ পপি সীড কেক! একবার দেখি আমার জন্য একটা গাছের ছোট কাটিং নিয়ে এসেছে।
ওর সুইডিশ গ্র্যান্ডমাদার যখন এ দেশে আসেন তখন একটা প্রিয় গাছ এনেছিলেন।
হাউজপ্লান্ট। সেই গাছের কাটিং ক’রে ক’রে এত বছর। দুই পুরুষ আগে সুইডেন থেকে
এসেছিলো ওরা।
পাশেই ফোর্ডস
থিয়েটার। এখানে আমেরিকার প্রিয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন-কে গুলি ক’রে মারা হয়। লাইব্রেরী অফ্ কনগ্রেস
দেখতে যাওয়া আছে। শোনা যায় এখন এটাই নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে
আন্তর্জাতিক লাইব্রেরী।
শুনবে সিনেট আর হাউজ কমিটি হিয়ারিং। প্রায় একমাস ধরে ওরা প্রশ্ন তৈরী করছে। টিচারকে দেখিয়ে তা ঠিক করছে। সিনেটরদের সাথে যে দেখা করবে, কি জিজ্ঞাসা করবে তখন? সিনেটর ট্যামি ব্যাল্ডউয়িন(ডেমোক্র্যাট)-এর জন্য হৈ-এর প্রশ্ন ক্রামিয়ান যুদ্ধ
নিয়ে। রিপ্রেজেনটেটিভ মার্ক পোকান-এর জন্য প্রশ্ন মারিজুয়ানা লিগালাইজেশন নিয়ে।
সুপ্রীম কোর্ট দেখা আছে, আছে ক্যাপিটাল ট্যুর।
ওল্ড টাউন আলেক্সন্দ্রিয়া, ইউ.এস. ইন্সটিটুইট অফ্ পিস্, পেন
কোয়ার্টার, কেনেডী সেন্টার, আর্লিংটন ন্যাশনাল সেমেটারী, ঘোস্ট এন্ড গ্রেভইয়ার্ডস ট্যুর,
ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু মেমরিয়্যাল, জেফারসন মেমরিয়্যাল, ইও জিমা মেমরিয়্যাল,মেরিন কর্পস্
মেমরিয়্যাল -
আরো কত কী!
সব চেয়ে বড় কথা ন্যাশনাল গ্যালারী অফ্ আর্ট দেখতে
যাবে ওরা। মহা উত্তেজিত হ’য়ে পরে উইকেপিডিয়া থেকে আর গুগল ক’রে জেনেছি রাফায়েল, এল্
গ্রেকো, রেম্ব্র্যান্ডট্, ম্যনে, ম্যানে, ভ্যান গগ্, গগ্যাঁ, সেজান, মাতিস, পিকাসো,
মেরী কাসাত্- আরো কত শিল্পীর অরিজিনাল পেন্টিং যে আছে ওখানে! এত সব ছবি? ভাবা যায়? আমার রাতের ঘুম গেল। যাক্ ফিরে এলে ‘বিলেত
ফেরত ছেলে’-র মত বলতে পারব ‘আমার স্বর্গ ফেরত ছেলে’।
কোরিয়ান
ওয়্যার মিউজিয়াম, ভিয়েতনাম ওয়্যার মিউজিয়াম দেখতে যাবে। জানাল, ‘ওখানে ওরা আমাদের আনবায়াসড্
ওপিনিয়ন দেবে।’
মনে
মনে শুধু বললাম সব ছেলেমেয়েগুলোই যেন কোনো দেশে যা কেউ দেখাবে না, যা কেউ বলে দেবে
না অথচ যা কিনা অন্য দেশের বুকের পাঁজর গুঁড়ো ক’রে দিয়েছে জীবনে তা খুঁজে পায়। রক্তের সমুদ্র এক নদীর জলে হ’য় না। নিজের
বুদ্ধিটুকু দিয়ে যেন ওরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে হুকুমটা কোথা থেকে আসছে।

ভিয়েতনাম ওয়াল – যত মানুষের নাম এখানে, খুঁজে
পাওয়া যাবে না তত লাল গোলাপ
দেখুক।
পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সব সব দেখুক। ডানদিক দেখুক, বামদিক চিনুক। সব মতগুলো
শুনুক। তবেই না কোন্দিকে সমুদ্র আছে খুঁজে পাবে।
এভাবেই ওরা বেড়ে উঠুক। এভাবেই
ওরা বড় হ’য়ে উঠুক। মুক্ত বাতাসে। যেভাবে ভাবতে চায়, যা ভাবতে চায়, শিখুক - মানবতার
সপক্ষে। বনের ভিতর ওই আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া, চারপাশ ছাপিয়ে পড়া ডগলাস ফারের মত। দুইশ’
ছেচল্লিশ ফুট লম্বা সেই গাছ। পাতায় পাতায় লকেটের মত বাদামী ‘কোন’
ঝুলে আছে। নরম ঝাউ পাতা। চোখের পাপড়িতে বোলাতে ইচ্ছা ক’রে। পাতার গায়ে খ্রিস্টমাসের
গন্ধ। ঝিলিমিলি সাজ। কত যে প্রেজেন্ট ঝুলছে। কে যেন বলেছিল সবচেয়ে সুখী পাখি
খ্রিস্টমাস ট্রি-তে বাসা বাঁধে। কিংবা হোক নাহয় বনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ওক গাছটা। চারশ’ বছর আয়ু।
পৃথিবীতে
কয়টা বাচ্চা কিছু শিখবার সুযোগ পায়? আমাদের
দেশে, ঢাকায় গাড়ির পাশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে হাতে বকুলফুলের মালা
নিয়ে। দশ পয়সা ক’রে দাম। তাও যদি বিক্রী হয়! দাঁড়িয়ে থাকে ওরা ছোট ছোট বাগরী পাখি
নিয়ে। খুব ঝাল দিয়ে কষিয়ে বাগরী রাঁধলে জিভ
থেকে জল ঝরে, চোখ থেকে জল ঝরে। দাঁড়িয়ে থাকে চখাচখি নিয়ে। ঘাড় মুচরানো। একবার হৈ,
তাথৈ-কে দেশে নিয়ে গেছি। ঘাড় মুচরানো চখাদের দেখে খুব অবাক হ’ল না ওরা। উইস্কনসিনে
ঘাড় মটকানো হরিণ অনেক দেখেছে। Fall-এ পাতা ঝরার সাথে সাথে অনেক মানুষ ভোল
পাল্টে শিকারী হ’য়ে গিয়ে বন্দুক কিংবা তীর ধনুক নিয়ে বের হ’য়। নিজেদের ট্রাকের
পিছনে ক’রে শিকার ক’রা হরিণ নিয়ে যায়। হাইওয়েতে তাদের পাশে গাড়ী প্রায়শই চালাতে
হয়। কিন্তু হৈ, তাথৈ খুবই আশ্চর্য হ’ল ঘাড় মুচরানো চখা বিক্রী ক’রা বাচ্চাগুলোকে দেখে।
‘ওদের
জুতা নেই?’
জীবন
কেটে যায়..................।
আমাদের
দেশে পাতা কুড়াতে কুড়াতেই বাচ্চাগুলোর জীবন কেটে যায়।
একবার
বান্ধবী সুস্মিতা
(আসলে
ও সুস্মি,
আজকাল সম্মান দেওয়ার জন্য বান্ধবী সুস্মিতা বলে ডাকছি), অন্য কয়েকজন
বন্ধু, আমি মিলে বিকেলবেলা পাতা কুড়ানো আর ঘুটে কুড়ানো বাচ্চাগুলোকে পড়ানোর জন্য
একটা স্কুল খুলেছিলাম। লাইন ক’রে দাঁড় করিয়ে জাতীয় সঙ্গীত শেখানো।
‘আমার সোনার
বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুর এবং গান। যতবার শুনি,
যতবার গাই – চোখে জল আসে।
‘কী শোভা,
কী
ছায়া গো,
কী স্নেহ,
কী
মায়া গো,
কী আঁচল বিছায়েছ
বটের মূলে,নদীর কূলে কূলে।’
ওদের
বর্ণমালা শেখাচ্ছি। চিঠি লিখতে শেখাচ্ছি – কোন ফাঁকি নেই আমাদের কাজে। তখনও বালিকা
ছিলাম কি না! তাই। আর 'অ' 'আ' শেখানোই তো শুধু নয়। ওদের খাবার দিতাম। জামা কাপড় দিতাম। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সব জোগাড় করতাম। কাঁকনের কী সুন্দর সুন্দর যে ভেলভেটের জামা ছিল। আমাদের দিল একটা মেরুন রঙ্গের ভেলভেটের জামা। সোণালি রঙ্গের জরির কাজ কোমরের কাছে। আর একটা শ্যাওলা সবুজ ভেলভেট। সে জামার গলার কাছে রূপালি জরি। এখনও বুকের ভিতর একটা নরম তুলো তুলো, তুলাপুটপুটি পাখির ভালোবাসা জেগে ওঠে ওই জামাদু'টোর কথা ভাবলে। টিয়া ছিল আমার প্রিয় ছাত্রী। ছয় সাত বছর বয়স। কী যে মিষ্টি! সবুজ জামাটা দিলাম। ওকে দেখতে একদম সত্যিকারের টিয়াপাখির মত লাগল।ভেলভেটের জামাটা পড়ে আমার টিয়া ঘুটে কুড়াতে থাকল।
প্রায় প্রতিদিনই বাচ্চাগুলো জিজ্ঞাসা করত। কি হ’বে লেখাপড়া
শিখে? শুধুমাত্র জানার জন্য, সবকিছু কিভাবে হয় বুঝবার জন্য মানুষ পড়াশোনা করে। এ
ভালোবাসা পৃথিবীর সব ভালোবাসার উপরে, সব থেকে দামী। অনেক পড়াশোনা করলে পিএইচ.ডি ডিগ্রী পায়
মানুষ। আর মাঝে মাঝে কোন মানুষের জ্ঞান অন্য মানুষদের মাঝে এতটাই আলো দেয় যে
তাঁদের নোবেল প্রাইজ দেওয়া হ’য় তখন। এ
সমস্ত অর্থহীন কথার ওদের জীবনের কোথাও কোন জায়গা নেই দেখে ওরা সম্মতি সূচক মাথা
নাড়ল। আমরাও অমন করি। যখন ‘না’
বলতে চাই, ‘হ্যাঁ’ বলি।কয়েকদিন
পর পরই পরীক্ষা নিতাম। পড়াশোনা শেখাটা তো ‘প্রিভিলেজ’ নয়। অধিকার।
প্রশ্নঃ
বল তো পানি বানান কি?
উত্তরঃ
‘ভ’-এ আকার, ‘ত’।
স্কুলের
সামনে দাঁড়িয়ে আছি।বাসে
প্রায় উঠবে উঠবে করছে ওরা।
আস্তে
ক'রে হৈ বলল, 'মম্, দে উইল টেক
আস টু সী দ্যা হলোকস্ট মিউজিয়্যাম টু।' আনা ফ্রাঙ্ক?
এপ্রিল
মাস হ'লেও উইস্কনসিনের সব বরফ এখনো গলেনি। খুব জোরে বাতাস দিল। এমন বরফ ঠান্ডা
বাতাস যখন চোখের মণিতে গিয়ে ধাক্কা দেয়, চোখের কোণ থেকে
জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়ে।
~কল্যাণী রমা
ফোনে বান্ধবী সুস্মিতা বলল, ‘কি রে তুলে দিয়ে এলি? ও মাই গস্! কাঁদছিস্? আর কাঁদবি নাই বা কেন? তুই তো প্রজাপতি উড়ে গেলেও কাঁদিস।’
হৈ-কে এই তুলে দিয়ে এলাম। রবিবার সকাল সাতটা। ভোরবেলা। বাসে ক’রে মিলওয়াকি যাবে। সেখান থেকে প্লেনে ওয়াশিংটন ডিসি। এই স্কুল ছেড়ে যাওয়ার আগে ক্লাশ এইটের সবাই মিলে শিক্ষকদের সাথে এক সপ্তাহের জন্য শিক্ষা সফর। খুব অল্প ছেলেমেয়ে হৈ-দের ক্লাশে। তিন সেকসন মিলিয়ে তিরিশজন। হৈ-এর সেকশনে দশজন। তবু এই কয়জনকে নিয়েই বড় শহরে হারিয়ে যাওয়া তো যেতেই পারে! খুব শৃংখলার মধ্যে জীবন না কাটালে আগডুম বাগডুম যা কিছুই হওয়া সম্ভব।
প্রিন্সিপাল বলে দিয়েছেন, ‘বাস আটটা-তে ছাড়বে। আটটা পাঁচে নয়। যদি আটটা পাঁচ হ’য়ে যায়, তবে আর স্কুলে আসবার প্রয়োজন নেই। বাবা মা-কে নিয়ে সোজা মিলওয়াকি চলে গেলেই হ’বে।’ মিলওয়াকি ম্যাডিসন থেকে একশ’ সাতাশ কিলোমিটার দূরে। হুমকিটার গুরত্ব এবং গাম্ভীর্য বিবেচনা করে সব বাবা, মা-ই আমাদের মত পাঁচ ঘরে পাঁচটা এলার্ম দিয়েছিল কিনা কে জানে। তবে রবিবারের সকালে সবাই ঘুম ভেঙ্গে উঠেছে এবং জোড়ো হয়েছে ‘ঈগল স্কুল অফ্ ম্যাডিসন’-এর সামনে।
উপস্থিত ড্যাসার, ড্যান্সার, প্র্যান্সার, ভিক্সেন, কমেট, কিউপিড, ডোনার, ব্লিটজেন এবং অবশ্যই রেড নোজ রুডলফ্।তবে কে যে আসল রুডলফ বোঝা ভীষণ শক্ত। নিজ ছানাকে নিয়ে সব মা বাবারই তো মনে মনে গুন্গুন্, ‘...do you recall the most famous reindeer of all…’
আজকাল সন্তান-সন্ততি নিয়ে এত্ত মুশকিল্! চাই চাই চাই। ব্র্যান্ডনেমড জামা চাই, আইপড চাই, আইপ্যাড চাই, ফোর জি ফোন চাই। বন্ধুদের আছে। আহা, টঙ্কা তো আর আপেল নয়। গাছে ধরে আছে। আর বাবা মা? আইস হকি শেখাতে নিয়ে চলল। হার্প। সবাই যেন মল্লযুদ্ধটা শিখে ফেলে। বন্ধ ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই সব নকল রক ক্লাইম্ব করতেই হ’বে। শেখাতে না নিয়ে গেলেও তো মুশকিল। পিছিয়ে পড়বে। কার পিছনে কে পড়বে? কেই বা সামনে? সামনেটাই বা কি?
মনে পড়ল খুব ছেলেবেলায় পড়া ভালেন্তিনা ওসেয়েভা-র লেখা ‘নীল পাতা’ বইটার কথা। ‘ছেলেরা’। কুয়ো থেকে জল তুলছে তিন গিন্নি। থুত্থুরে এক বুড়ো জিরতে বসে আছে কাছেই। পাথরের উপর। হঠাত্ ছুটে আসে তিনটি ছেলে। একজন হাতে ভর দিয়ে বনবন করে ডিগবাজি খায়। অন্য ছেলেটা গান ধরে। যেন কোকিল গাইছে। তিন নাম্বার ছেলেটা এসে মায়ের হাত থেকে ভারি বালতিটা নিয়ে নিজেই বইতে থাকে। বুড়োকে গিন্নিদের প্রশ্নঃ ‘তা কেমন দেখলেন আমাদের ছেলেদের?’‘ছেলেরা আবার কোথায়? – জবাব দেয় বুড়ো, - আমি তো কেবল একটি ছেলেকে দেখছি।’
ছুটির দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হ’য়ে যায় টিম ফোট্রেস টু। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চলছে সেই একই ভিডিও গেম। দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে সত্যিকারের কথা না ব’লে ‘LOL’ ল্যাংগোয়েজে টেক্সট করে চলেছে। কিংবা মা বাবার সাথে বলছে টীন এজ বয়সের ভাষা মিশরীয় “হাইরোগ্লিফিকস্”। ঘরের দরজাটা খুললেই যে সত্যিকারের আমগাছটা দাঁড়িয়ে আছে, তা থেকে ঝাপিয়ে পড়ে ‘ঝাই ঝাপ্পা কানাই মাছি’ খেলবার দিন শেষ। আর মালবেরী গাছে চড়ে বেগুনী জামা, বেগুনী মুখ? মা বাবার স্মৃতির শৈশব!
প্রায় একমাসের উপর কী হুলস্থুলই না চলছে। ড্রেস প্যান্ট, ড্রেস শার্ট, ফরমাল স্যুট, সেমাই ফরমাল, ক্যাজুয়াল – হট্টগোলের চূড়ান্ত। একজন মা আবার খবর দিল, সে নাকি খ্রীস্টমাসের সময় সেলে মেয়ের জন্য স্যুট কিনেছে। প্রায় অর্ধেক দামে পেয়েছে। কিন্তু আমার তো সবসময়ই ট্রেন ফেল! বাবার-ও মোটামুটি ফেল ফেল অবস্থা। আগে টাই বাঁধা শেখানো হয় নি। যাওয়ার আগের দিন রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেকে নিয়ে লাফঝাঁপ। টাই-এর লেজ উঠছে, নামছে। Seesaw। এদিকে জামাকাপড়ের পাতাবাহার দেখেও বোঝা মুশ্কিল। এরা সিনেটরদের সাথে দেখা করবে নাকি নিজেরাই সিনেটর হ’বে! পাবলিক এপিয়ারেন্স দিতে গিয়ে যেন কোনরকম ‘ক্লজেট ম্যালফাংক্শন’ না হ’য়ে যায়। রাজধানী ব’লে কথা। তার উপর আবার আকাশের মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে চেরীফুল ফুটছে।
আমি এত্ত নার্ভাস! অত্যাচারে অতিষ্ট হ’য়ে হৈ তো বলেই দিল,‘মম্, ইউ আর সাফারিং ফ্রম এমটি নেস্ট সিন্ড্রম্! গেট ইউজড্ টু ইট। সুন আই উইল বি অফ্ টু কলেজ!’
আমার এও যত্ন! গুঁজে দিলাম দু’টো টুথব্রাশ। এমন নয় যে দুই ব্যাগে। একটা হারালে আর একটা পাবে। সব এক পকেটেই ধাক্কাধাক্কি।
‘ম-ম্, আই হ্যাভ জাস্ট ওয়ান মাউথ!’
মোটামুটি সকলেরই বাবা মা দু’জনই উপস্থিত। শুধু একজন বীর সেনানী অন্য বন্ধুর বাবা মা-র সাথে কারপুল ক’রে এসেছে।বেশির ভাগ বাচ্চাই এই প্রথম বাবা মাকে ছেড়ে এক সপ্তাহের জন্য একা বাইরে কোথাও যাচ্ছে। একজন মা যদিও বলল তার ছেলে নাকি গত সামারে একাই তিন সপ্তাহের জন্য ইউরোপ ঘুরতে গিয়েছিলো। বুঝতে পারলাম এখানেও আমি লেজে গোবরে, ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা! ট্রেনিংটা ঠিক হয়নি। ছানাদের নিয়ে এখনও শুধু আকুলি বিকুলি মাম্মা। যাওয়ার আগে বিদায়ী হাগ দিতে গেলাম। ছানা আমার মুরগীর মত দু’পাশে ডানা মেলে দাঁড়িয়ে থাকল। জনসমক্ষে টিন এজ বাচ্চারা এমনিই ক’রে।
অথচ যখন আমি ক্লাশ ফাইভে পড়ি আর ছোটবোন ক্লাশ টু-তে, ঠিক হ’ল মা-কে দেখতে ইংল্যান্ড যাব। ঢাকার তেজগাঁ এয়ারপোর্ট থেকে তুলে দেওয়া হ’ল। হিথ্রো-তে নামিয়ে নেবে মা। দেখে ফেললাম বাকিংহাম প্যালেস, গার্ড চেঞ্জ, প্ল্যানেটোরিয়াম, মাদাম ত্যুসো, ইংলিশ চ্যানেল, টেমস্ নদী, টাওয়ার অফ্ লন্ডন, শেক্সপিয়ারের বাড়ি কত কী। তুলনাহীন অভিজ্ঞতা। আর ছোট দু’টো মানুষ একা একা ‘বিলাত ভ্রমণে’ বের হয়েছে বলে এয়ারহোস্টেসদের কী যত্ন, কী যত্ন। কী ভালোই যে লেগে গেল ওদের। কিন্তু এ কি? শাদা মুখ, কালো পা? পরে কে যেন বলল ওরা কালো টাইটস্ পড়েছে। সেই কবেকার কথা! কিন্তু এমনই বিস্ময়ের ঘোর লেগেছিল যে আজও এই গল্পটা মনে আছে।
আর ক্লাশ সেভেন, এইট থেকে সেইসব ক্যাম্পের কথা? আমি রাজশাহী, ঢাকা যাওয়ার চান্স পেয়েছিলাম গার্ল গাইডস থেকে, রেড-ক্রস থেকে। গোপন খবর হ’ল আমাদের বাড়ির কড়া শাসনের পাল্লায় পড়ে স্বাধীন, উড়ন্ত বলাকা সুস্মিতার মত সিলেট, চিটাগাং যাওয়ার চান্স পাওয়া যায় নি!
একবার মাদার তেরেসা ঢাকায় এসেছেন। আমি রেডক্রস ক্যাম্পে। নিজের গায়ে আগুন না ধরিয়ে কী যেন একটা ডিম পেড়েছি না ডিম ওমলেট করেছি। পেয়ে ফেল্লাম মাদার তেরেসার হাত থেকে মেডেল। আজও সে মেডেল ফায়ার-প্লেসের উপর থেকে স্বপ্নের ভিতর ঝুলিয়ে রেখেছি।
রাজশাহীতে গার্ল গাইডস ক্যাম্প। আমরা ভালো ব্যাং ভাজতে পারি, আমরা ভালো ব্যাং-এর মত গলা সাধতে পারি, আমরা ভালো ব্যাং-এর মত লাফ দিতে পারি। এতই যে সব ভালো পারি, আমাদের দেখিয়ে আমাদের লাফ ঝাঁপ কে নিজের দেওয়া শিক্ষা বলে শেষমেষ আমাদের গাইড আপা অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। আমরা ব্যাং বাবাজীবন সব কূয়ার মধ্যে থেকে গেলাম। সে দুঃখের কথা নিঃশব্দে বুকে চেপে রাখাই ভালো। ‘গাইড দীপটি নিভাতে চাই, নিভাতে চাই।’
আর একবার। পি এন স্কুলে ক্যাম্প। টান্ টান্ তাঁবু টানানো হয়েছে। খবরের কাগজ বুনে বুনে মাটিতে বসবার ম্যাট ‘সীট-আপন’, রীফনট্, ফিশারম্যানস্ নট, রূপসী ফিগার এইট নট্ সব হাতে কলমে শেখা শেষ। রাত হ’য়ে গেছে। টেন্টের মেঝেময় খড় বিছানো। তার উপর নিজ নিজ হোল্ড-অল পেতে আমাদের বিছানা। হোল্ড-অল খুলতে গেছি, ‘ফোঁস’! ফনা তুলে গোখরা। খড়ের নীচ থেকে। বেচারা শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল। মাথায় খড়ম আঁকা।
‘কাট্, কাট্’, বান্ধবী সুস্মিতা এসে গেছে!
‘সব সবসময় গুল মারিস্ কেন? মোটেই গোখরা ছিল না। তুই নিজ চোখে খড়ম দেখেছিস্?’
‘বাহ্ রে! তাও তো পাইথন বলি নি। শোন্, গুল বলে কোন কথা নেই। কথা যখন বলবি সবসময় একটু সুন্দর করে, রঙ্গিন ক’রে বলবি যেন যারা শুনছে তাদের মনে হয়
বিরিয়ানী খাচ্ছে! মাথায় দোলনচাঁপা দিয়ে যখন সাজিস্, তোর ভালো লাগে। অন্যদেরও ভালো লাগে। দেখ্ না যেমন আমি সবসময় বলে থাকি
টিসাকে স্কুলের পিকনিকে চিড়িয়াখানায় বানর কামড়ে দিয়েছিল। আসলে নাকি গরাদের ফাঁক
দিয়ে বানর আঁচড় মেরেছিল।’
যাহোক, সে রাতে আর টর্চ নিয়ে কেউ গোখরা বা পাইথন দেখতে গেল না। আমাদের টেন্টে শুতে দিল না। সোজা স্কুলঘরের মাটি।
বন্ধুগণ, এইসব অতীত কাহিনীর আরব্য রজনীর গল্প বলবার একটাই কারণ। তখনকার স্ট্যান্ডার্ডে অনেক পুতুপুতু ক’রে আমরা বড় হলেও ছেলেবেলায় এইসব ছোটাখাট এভারেষ্ট জয় করতে আমাদের বাবা মা কিন্তু দিয়েছিল। মে মাসে চোদ্দ বছর হ'বে হৈ-এর। তবে আমার কেন এই চরম দুরাবস্থা? শুধু আমাদের ছানাপোনাই আমাদের রক্তের সন্তান?
যাওয়ার আগে হৈ-এর প্রিয়তম বন্ধুর মা বলল, ‘এতগুলো টাকা হাতখরচ আর লাঞ্চ কিনবার জন্য দেব। একঘন্টার মধ্যে তো নিকোলাস সব হারিয়ে ফেলবে। একদম সম্ভব। উইস্কনসিনে কী বরফই না পড়ে। প্রায় হাঁটুসমান। বহুদিন দেখেছি স্কুলে যাওয়ার সময় শীতকালেও নিকোলাস এসেছে মোজা আর ক্লগ পড়ে। সমুদ্রসৈকত তো নয়! আসলে স্কুলের জুতা পড়তে ভুলে গেছে।
আমাদের হৈ-ও কম যায় না। নিজ স্কুলের বাইরে বেশ বড়সর এক পরীক্ষা দিতে যাবে। বারবার বলেছি ক্যালকুলেটর-টা মনে ক’রে বাড়ি এন। স্কুল কিন্তু সোমবার সকাল আটটার আগে খুলবে না। শনিবার পরীক্ষা। যথারীতি। পরীক্ষার আগের দিন রাত বারোটায় জানা গেল ক্যালকুলেটার বাড়ি আসেননি। ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী হ’য়ে তখন ক্যালকুলেটার কিনবার পালা! সকলের দাঁতে দাঁত ঘষা বন্ধ হ’লে,
‘তা
কোথায় রেখে এসেছ ক্যালকুলেটারটা?’
‘স্কুলে, জিম সুর নীচে। ভালো ক’রে চাপা দিয়েছি। খুব সেফ।’ শুনলেই তো আমার মা হার্টফেল করবে। পড়াশোনার কোন জিনিষে জুতা ছুঁইয়েছ? আর আমি সেফটিনেটে সদ্য ধরা পড়া মাছের মত ছট্ফট্!ছোটবোন তাথৈ এটা এগিয়ে দেয়, সেটা এগিয়ে দেয়। শেষমেষ কাঠি, গুলি দিয়ে একটা এ্যাবাকাস বানিয়ে ধরিয়ে দেবে কিনা কে জানে। সব ভাই আর দাদাগুলোই বুঝি এমন বুদ্ধিমতী মাশার ভাই!
স্কুলের বই ভুলে স্কুলে এসে হাজির ভিতিয়া । ‘কী হবে এখন? ঘন্টা পড়ে গেল...দরজা খোলে-খোলে...’ ‘ববিক, রবিক, লবিক, জুবিক!’ ডাক পড়ল চার কুকুরের। তাদের মুখে বই খাতা গুঁজে দিল বুদ্ধিমতী মাশা। কী দৌড়, কী দৌড়। দিদিমণি আসবার একটু আগেই বই খাতা নিয়ে এসে হাজির কুকুরেরা। সাথে চিঠি। লেখা আছে, ‘তুই একটা ভুলো। তোর দিদি মাশা।’
কিন্তু গল্প তো গল্পই। নিকোলাসের মা’র চিন্তার কথা হৈ-কে বলতেই ততক্ষণাত্, ‘নট টু ওয়ারি। আই উইল স্ট্যান্ড বাই মাই ফ্রেন্ড!’ নিকোলাসের মা-কে সে কথা বলতেই হাসতে হাসতে, ‘নিশ্চয়!’
গাড়িতে ক'রে স্কুলে যাওয়ার পথে হৈ-এর নানা গল্প। পরে স্কেজুল দেখে কোন কোন জায়গায় যাবে শুনে আর উইকিপিডিয়া উল্টে জ্ঞান আমার আরো বেড়ে গেল।
ওরা জর্জটাউন হোটেলে
থাকবে। ওল্ড ইউরোপ রেস্টুরেন্ট, ইউনিয়ন
স্টেশন, ওল্ড টাউন আলেকসন্দ্রিয়া-তে ডানিয়েল ও’কনাল
রেস্টুরেন্ট, কাস্কেড কাফে, মিঃ স্মিথ্স
জর্জটাউন-এ খাওয়া দাওয়া। জিভে জল এল!
শোনা গেল আছে নাকি টোয়াইলাইট ডিনার এন্ড ড্যান্স ক্রুজ। টোয়াইলাইটের আলোতে ড্যান্স করতে গিয়ে অজানা বনে বাবা ইয়াগা না তাড়া ক’রে! সে নাচ জানে না।
‘আমরা হোয়াইট হাউজ দেখতে যাব।’ বাহ্! বোঝা গেল হোয়াইট হাউজ-এর লোহার কালো বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবার সুযোগ পাবে। দেখে ফেলবে স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম, নিউজিয়াম, লিঙ্কন মিউজিয়াম। আলবার্ট আইনস্টাইন মিউজিয়াম-ও ।
ন্যাশনাল ক্যাথিড্রালের লাল-নীল রঙ্গের দুইশ’ স্টেইন্ড্ গ্লাসের উইন্ডো দিয়ে
বাইরের পৃথিবীটা দেখবে। জানালায় স্বপ্নে আঁকা কাচের গোলাপ!
যাওয়া আছে চায়না টাউনে। ইমিগ্রান্ট্দের গল্প সবসময় আমাকে এত মোহগ্রস্ত ক’রে! আমেরিকার প্যাচওয়ার্ক কুইল্টে এক একটা স্কয়ার ওরা। শুধু তো নিজেরাই আসে নি। সাথে এসেছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, নিজ নিজ ঘরের রান্নাগুলো, ঠাকুরদাদার গল্প, নাচ, গান। ফেলে আসা কান্না আর স্মৃতি। পাশের বাড়ির প্রিয় বন্ধু ডেবরা মাঝে মাঝেই আমাকে নানা রান্নার রেসিপি দিত। সুইডিশ পপি সীড কেক! একবার দেখি আমার জন্য একটা গাছের ছোট কাটিং নিয়ে এসেছে। ওর সুইডিশ গ্র্যান্ডমাদার যখন এ দেশে আসেন তখন একটা প্রিয় গাছ এনেছিলেন। হাউজপ্লান্ট। সেই গাছের কাটিং ক’রে ক’রে এত বছর। দুই পুরুষ আগে সুইডেন থেকে এসেছিলো ওরা।
পাশেই ফোর্ডস থিয়েটার। এখানে আমেরিকার প্রিয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন-কে গুলি ক’রে মারা হয়। লাইব্রেরী অফ্ কনগ্রেস দেখতে যাওয়া আছে। শোনা যায় এখন এটাই নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে আন্তর্জাতিক লাইব্রেরী।
শুনবে সিনেট আর হাউজ কমিটি হিয়ারিং। প্রায় একমাস ধরে ওরা প্রশ্ন তৈরী করছে। টিচারকে দেখিয়ে তা ঠিক করছে। সিনেটরদের সাথে যে দেখা করবে, কি জিজ্ঞাসা করবে তখন? সিনেটর ট্যামি ব্যাল্ডউয়িন(ডেমোক্র্যাট)-এর জন্য হৈ-এর প্রশ্ন ক্রামিয়ান যুদ্ধ নিয়ে। রিপ্রেজেনটেটিভ মার্ক পোকান-এর জন্য প্রশ্ন মারিজুয়ানা লিগালাইজেশন নিয়ে।
সুপ্রীম কোর্ট দেখা আছে, আছে ক্যাপিটাল ট্যুর। ওল্ড টাউন আলেক্সন্দ্রিয়া, ইউ.এস. ইন্সটিটুইট অফ্ পিস্, পেন কোয়ার্টার, কেনেডী সেন্টার, আর্লিংটন ন্যাশনাল সেমেটারী, ঘোস্ট এন্ড গ্রেভইয়ার্ডস ট্যুর, ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু মেমরিয়্যাল, জেফারসন মেমরিয়্যাল, ইও জিমা মেমরিয়্যাল,মেরিন কর্পস্ মেমরিয়্যাল - আরো কত কী!
সব চেয়ে বড় কথা ন্যাশনাল গ্যালারী অফ্ আর্ট দেখতে যাবে ওরা। মহা উত্তেজিত হ’য়ে পরে উইকেপিডিয়া থেকে আর গুগল ক’রে জেনেছি রাফায়েল, এল্ গ্রেকো, রেম্ব্র্যান্ডট্, ম্যনে, ম্যানে, ভ্যান গগ্, গগ্যাঁ, সেজান, মাতিস, পিকাসো, মেরী কাসাত্- আরো কত শিল্পীর অরিজিনাল পেন্টিং যে আছে ওখানে! এত সব ছবি? ভাবা যায়? আমার রাতের ঘুম গেল। যাক্ ফিরে এলে ‘বিলেত ফেরত ছেলে’-র মত বলতে পারব ‘আমার স্বর্গ ফেরত ছেলে’।
কোরিয়ান ওয়্যার মিউজিয়াম, ভিয়েতনাম ওয়্যার মিউজিয়াম দেখতে যাবে। জানাল, ‘ওখানে ওরা আমাদের আনবায়াসড্ ওপিনিয়ন দেবে।’
মনে মনে শুধু বললাম সব ছেলেমেয়েগুলোই যেন কোনো দেশে যা কেউ দেখাবে না, যা কেউ বলে দেবে না অথচ যা কিনা অন্য দেশের বুকের পাঁজর গুঁড়ো ক’রে দিয়েছে জীবনে তা খুঁজে পায়। রক্তের সমুদ্র এক নদীর জলে হ’য় না। নিজের বুদ্ধিটুকু দিয়ে যেন ওরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে হুকুমটা কোথা থেকে আসছে।
দেখুক।
পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সব সব দেখুক। ডানদিক দেখুক, বামদিক চিনুক। সব মতগুলো
শুনুক। তবেই না কোন্দিকে সমুদ্র আছে খুঁজে পাবে।
এভাবেই ওরা বেড়ে উঠুক। এভাবেই ওরা বড় হ’য়ে উঠুক। মুক্ত বাতাসে। যেভাবে ভাবতে চায়, যা ভাবতে চায়, শিখুক - মানবতার সপক্ষে। বনের ভিতর ওই আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া, চারপাশ ছাপিয়ে পড়া ডগলাস ফারের মত। দুইশ’ ছেচল্লিশ ফুট লম্বা সেই গাছ। পাতায় পাতায় লকেটের মত বাদামী ‘কোন’ ঝুলে আছে। নরম ঝাউ পাতা। চোখের পাপড়িতে বোলাতে ইচ্ছা ক’রে। পাতার গায়ে খ্রিস্টমাসের গন্ধ। ঝিলিমিলি সাজ। কত যে প্রেজেন্ট ঝুলছে। কে যেন বলেছিল সবচেয়ে সুখী পাখি খ্রিস্টমাস ট্রি-তে বাসা বাঁধে। কিংবা হোক নাহয় বনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ওক গাছটা। চারশ’ বছর আয়ু।
পৃথিবীতে কয়টা বাচ্চা কিছু শিখবার সুযোগ পায়? আমাদের দেশে, ঢাকায় গাড়ির পাশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে হাতে বকুলফুলের মালা নিয়ে। দশ পয়সা ক’রে দাম। তাও যদি বিক্রী হয়! দাঁড়িয়ে থাকে ওরা ছোট ছোট বাগরী পাখি নিয়ে। খুব ঝাল দিয়ে কষিয়ে বাগরী রাঁধলে জিভ থেকে জল ঝরে, চোখ থেকে জল ঝরে। দাঁড়িয়ে থাকে চখাচখি নিয়ে। ঘাড় মুচরানো। একবার হৈ, তাথৈ-কে দেশে নিয়ে গেছি। ঘাড় মুচরানো চখাদের দেখে খুব অবাক হ’ল না ওরা। উইস্কনসিনে ঘাড় মটকানো হরিণ অনেক দেখেছে। Fall-এ পাতা ঝরার সাথে সাথে অনেক মানুষ ভোল পাল্টে শিকারী হ’য়ে গিয়ে বন্দুক কিংবা তীর ধনুক নিয়ে বের হ’য়। নিজেদের ট্রাকের পিছনে ক’রে শিকার ক’রা হরিণ নিয়ে যায়। হাইওয়েতে তাদের পাশে গাড়ী প্রায়শই চালাতে হয়। কিন্তু হৈ, তাথৈ খুবই আশ্চর্য হ’ল ঘাড় মুচরানো চখা বিক্রী ক’রা বাচ্চাগুলোকে দেখে।
‘ওদের জুতা নেই?’
জীবন কেটে যায়..................।
আমাদের দেশে পাতা কুড়াতে কুড়াতেই বাচ্চাগুলোর জীবন কেটে যায়।
একবার বান্ধবী সুস্মিতা (আসলে ও সুস্মি, আজকাল সম্মান দেওয়ার জন্য বান্ধবী সুস্মিতা বলে ডাকছি), অন্য কয়েকজন বন্ধু, আমি মিলে বিকেলবেলা পাতা কুড়ানো আর ঘুটে কুড়ানো বাচ্চাগুলোকে পড়ানোর জন্য একটা স্কুল খুলেছিলাম। লাইন ক’রে দাঁড় করিয়ে জাতীয় সঙ্গীত শেখানো।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুর এবং গান। যতবার শুনি, যতবার গাই – চোখে জল আসে।
‘কী শোভা,
কী ছায়া গো,
কী স্নেহ,
কী মায়া গো,
কী আঁচল বিছায়েছ
বটের মূলে,নদীর কূলে কূলে।’
ওদের বর্ণমালা শেখাচ্ছি। চিঠি লিখতে শেখাচ্ছি – কোন ফাঁকি নেই আমাদের কাজে। তখনও বালিকা ছিলাম কি না! তাই। আর 'অ' 'আ' শেখানোই তো শুধু নয়। ওদের খাবার দিতাম। জামা কাপড় দিতাম। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সব জোগাড় করতাম। কাঁকনের কী সুন্দর সুন্দর যে ভেলভেটের জামা ছিল। আমাদের দিল একটা মেরুন রঙ্গের ভেলভেটের জামা। সোণালি রঙ্গের জরির কাজ কোমরের কাছে। আর একটা শ্যাওলা সবুজ ভেলভেট। সে জামার গলার কাছে রূপালি জরি। এখনও বুকের ভিতর একটা নরম তুলো তুলো, তুলাপুটপুটি পাখির ভালোবাসা জেগে ওঠে ওই জামাদু'টোর কথা ভাবলে। টিয়া ছিল আমার প্রিয় ছাত্রী। ছয় সাত বছর বয়স। কী যে মিষ্টি! সবুজ জামাটা দিলাম। ওকে দেখতে একদম সত্যিকারের টিয়াপাখির মত লাগল।ভেলভেটের জামাটা পড়ে আমার টিয়া ঘুটে কুড়াতে থাকল।
প্রায় প্রতিদিনই বাচ্চাগুলো জিজ্ঞাসা করত। কি হ’বে লেখাপড়া শিখে? শুধুমাত্র জানার জন্য, সবকিছু কিভাবে হয় বুঝবার জন্য মানুষ পড়াশোনা করে। এ ভালোবাসা পৃথিবীর সব ভালোবাসার উপরে, সব থেকে দামী। অনেক পড়াশোনা করলে পিএইচ.ডি ডিগ্রী পায় মানুষ। আর মাঝে মাঝে কোন মানুষের জ্ঞান অন্য মানুষদের মাঝে এতটাই আলো দেয় যে তাঁদের নোবেল প্রাইজ দেওয়া হ’য় তখন। এ সমস্ত অর্থহীন কথার ওদের জীবনের কোথাও কোন জায়গা নেই দেখে ওরা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। আমরাও অমন করি। যখন ‘না’ বলতে চাই, ‘হ্যাঁ’ বলি।কয়েকদিন পর পরই পরীক্ষা নিতাম। পড়াশোনা শেখাটা তো ‘প্রিভিলেজ’ নয়। অধিকার।
প্রশ্নঃ বল তো পানি বানান কি?
উত্তরঃ ‘ভ’-এ আকার, ‘ত’।
স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।বাসে প্রায় উঠবে উঠবে করছে ওরা।
আস্তে ক'রে হৈ বলল, 'মম্, দে উইল টেক আস টু সী দ্যা হলোকস্ট মিউজিয়্যাম টু।' আনা ফ্রাঙ্ক?
এপ্রিল মাস হ'লেও উইস্কনসিনের সব বরফ এখনো গলেনি। খুব জোরে বাতাস দিল। এমন বরফ ঠান্ডা বাতাস যখন চোখের মণিতে গিয়ে ধাক্কা দেয়, চোখের কোণ থেকে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়ে।
ফোনে বান্ধবী সুস্মিতা বলল, ‘কি রে তুলে দিয়ে এলি? ও মাই গস্! কাঁদছিস্? আর কাঁদবি নাই বা কেন? তুই তো প্রজাপতি উড়ে গেলেও কাঁদিস।’
হৈ-কে এই তুলে দিয়ে এলাম। রবিবার সকাল সাতটা। ভোরবেলা। বাসে ক’রে মিলওয়াকি যাবে। সেখান থেকে প্লেনে ওয়াশিংটন ডিসি। এই স্কুল ছেড়ে যাওয়ার আগে ক্লাশ এইটের সবাই মিলে শিক্ষকদের সাথে এক সপ্তাহের জন্য শিক্ষা সফর। খুব অল্প ছেলেমেয়ে হৈ-দের ক্লাশে। তিন সেকসন মিলিয়ে তিরিশজন। হৈ-এর সেকশনে দশজন। তবু এই কয়জনকে নিয়েই বড় শহরে হারিয়ে যাওয়া তো যেতেই পারে! খুব শৃংখলার মধ্যে জীবন না কাটালে আগডুম বাগডুম যা কিছুই হওয়া সম্ভব।
প্রিন্সিপাল বলে দিয়েছেন, ‘বাস আটটা-তে ছাড়বে। আটটা পাঁচে নয়। যদি আটটা পাঁচ হ’য়ে যায়, তবে আর স্কুলে আসবার প্রয়োজন নেই। বাবা মা-কে নিয়ে সোজা মিলওয়াকি চলে গেলেই হ’বে।’ মিলওয়াকি ম্যাডিসন থেকে একশ’ সাতাশ কিলোমিটার দূরে। হুমকিটার গুরত্ব এবং গাম্ভীর্য বিবেচনা করে সব বাবা, মা-ই আমাদের মত পাঁচ ঘরে পাঁচটা এলার্ম দিয়েছিল কিনা কে জানে। তবে রবিবারের সকালে সবাই ঘুম ভেঙ্গে উঠেছে এবং জোড়ো হয়েছে ‘ঈগল স্কুল অফ্ ম্যাডিসন’-এর সামনে।
উপস্থিত ড্যাসার, ড্যান্সার, প্র্যান্সার, ভিক্সেন, কমেট, কিউপিড, ডোনার, ব্লিটজেন এবং অবশ্যই রেড নোজ রুডলফ্।তবে কে যে আসল রুডলফ বোঝা ভীষণ শক্ত। নিজ ছানাকে নিয়ে সব মা বাবারই তো মনে মনে গুন্গুন্, ‘...do you recall the most famous reindeer of all…’
আজকাল সন্তান-সন্ততি নিয়ে এত্ত মুশকিল্! চাই চাই চাই। ব্র্যান্ডনেমড জামা চাই, আইপড চাই, আইপ্যাড চাই, ফোর জি ফোন চাই। বন্ধুদের আছে। আহা, টঙ্কা তো আর আপেল নয়। গাছে ধরে আছে। আর বাবা মা? আইস হকি শেখাতে নিয়ে চলল। হার্প। সবাই যেন মল্লযুদ্ধটা শিখে ফেলে। বন্ধ ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই সব নকল রক ক্লাইম্ব করতেই হ’বে। শেখাতে না নিয়ে গেলেও তো মুশকিল। পিছিয়ে পড়বে। কার পিছনে কে পড়বে? কেই বা সামনে? সামনেটাই বা কি?
মনে পড়ল খুব ছেলেবেলায় পড়া ভালেন্তিনা ওসেয়েভা-র লেখা ‘নীল পাতা’ বইটার কথা। ‘ছেলেরা’। কুয়ো থেকে জল তুলছে তিন গিন্নি। থুত্থুরে এক বুড়ো জিরতে বসে আছে কাছেই। পাথরের উপর। হঠাত্ ছুটে আসে তিনটি ছেলে। একজন হাতে ভর দিয়ে বনবন করে ডিগবাজি খায়। অন্য ছেলেটা গান ধরে। যেন কোকিল গাইছে। তিন নাম্বার ছেলেটা এসে মায়ের হাত থেকে ভারি বালতিটা নিয়ে নিজেই বইতে থাকে। বুড়োকে গিন্নিদের প্রশ্নঃ ‘তা কেমন দেখলেন আমাদের ছেলেদের?’‘ছেলেরা আবার কোথায়? – জবাব দেয় বুড়ো, - আমি তো কেবল একটি ছেলেকে দেখছি।’
ছুটির দিনে সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হ’য়ে যায় টিম ফোট্রেস টু। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত চলছে সেই একই ভিডিও গেম। দুই বন্ধু নিজেদের মধ্যে সত্যিকারের কথা না ব’লে ‘LOL’ ল্যাংগোয়েজে টেক্সট করে চলেছে। কিংবা মা বাবার সাথে বলছে টীন এজ বয়সের ভাষা মিশরীয় “হাইরোগ্লিফিকস্”। ঘরের দরজাটা খুললেই যে সত্যিকারের আমগাছটা দাঁড়িয়ে আছে, তা থেকে ঝাপিয়ে পড়ে ‘ঝাই ঝাপ্পা কানাই মাছি’ খেলবার দিন শেষ। আর মালবেরী গাছে চড়ে বেগুনী জামা, বেগুনী মুখ? মা বাবার স্মৃতির শৈশব!
প্রায় একমাসের উপর কী হুলস্থুলই না চলছে। ড্রেস প্যান্ট, ড্রেস শার্ট, ফরমাল স্যুট, সেমাই ফরমাল, ক্যাজুয়াল – হট্টগোলের চূড়ান্ত। একজন মা আবার খবর দিল, সে নাকি খ্রীস্টমাসের সময় সেলে মেয়ের জন্য স্যুট কিনেছে। প্রায় অর্ধেক দামে পেয়েছে। কিন্তু আমার তো সবসময়ই ট্রেন ফেল! বাবার-ও মোটামুটি ফেল ফেল অবস্থা। আগে টাই বাঁধা শেখানো হয় নি। যাওয়ার আগের দিন রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেকে নিয়ে লাফঝাঁপ। টাই-এর লেজ উঠছে, নামছে। Seesaw। এদিকে জামাকাপড়ের পাতাবাহার দেখেও বোঝা মুশ্কিল। এরা সিনেটরদের সাথে দেখা করবে নাকি নিজেরাই সিনেটর হ’বে! পাবলিক এপিয়ারেন্স দিতে গিয়ে যেন কোনরকম ‘ক্লজেট ম্যালফাংক্শন’ না হ’য়ে যায়। রাজধানী ব’লে কথা। তার উপর আবার আকাশের মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে চেরীফুল ফুটছে।
আমি এত্ত নার্ভাস! অত্যাচারে অতিষ্ট হ’য়ে হৈ তো বলেই দিল,‘মম্, ইউ আর সাফারিং ফ্রম এমটি নেস্ট সিন্ড্রম্! গেট ইউজড্ টু ইট। সুন আই উইল বি অফ্ টু কলেজ!’
আমার এও যত্ন! গুঁজে দিলাম দু’টো টুথব্রাশ। এমন নয় যে দুই ব্যাগে। একটা হারালে আর একটা পাবে। সব এক পকেটেই ধাক্কাধাক্কি।
‘ম-ম্, আই হ্যাভ জাস্ট ওয়ান মাউথ!’
মোটামুটি সকলেরই বাবা মা দু’জনই উপস্থিত। শুধু একজন বীর সেনানী অন্য বন্ধুর বাবা মা-র সাথে কারপুল ক’রে এসেছে।বেশির ভাগ বাচ্চাই এই প্রথম বাবা মাকে ছেড়ে এক সপ্তাহের জন্য একা বাইরে কোথাও যাচ্ছে। একজন মা যদিও বলল তার ছেলে নাকি গত সামারে একাই তিন সপ্তাহের জন্য ইউরোপ ঘুরতে গিয়েছিলো। বুঝতে পারলাম এখানেও আমি লেজে গোবরে, ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা! ট্রেনিংটা ঠিক হয়নি। ছানাদের নিয়ে এখনও শুধু আকুলি বিকুলি মাম্মা। যাওয়ার আগে বিদায়ী হাগ দিতে গেলাম। ছানা আমার মুরগীর মত দু’পাশে ডানা মেলে দাঁড়িয়ে থাকল। জনসমক্ষে টিন এজ বাচ্চারা এমনিই ক’রে।
অথচ যখন আমি ক্লাশ ফাইভে পড়ি আর ছোটবোন ক্লাশ টু-তে, ঠিক হ’ল মা-কে দেখতে ইংল্যান্ড যাব। ঢাকার তেজগাঁ এয়ারপোর্ট থেকে তুলে দেওয়া হ’ল। হিথ্রো-তে নামিয়ে নেবে মা। দেখে ফেললাম বাকিংহাম প্যালেস, গার্ড চেঞ্জ, প্ল্যানেটোরিয়াম, মাদাম ত্যুসো, ইংলিশ চ্যানেল, টেমস্ নদী, টাওয়ার অফ্ লন্ডন, শেক্সপিয়ারের বাড়ি কত কী। তুলনাহীন অভিজ্ঞতা। আর ছোট দু’টো মানুষ একা একা ‘বিলাত ভ্রমণে’ বের হয়েছে বলে এয়ারহোস্টেসদের কী যত্ন, কী যত্ন। কী ভালোই যে লেগে গেল ওদের। কিন্তু এ কি? শাদা মুখ, কালো পা? পরে কে যেন বলল ওরা কালো টাইটস্ পড়েছে। সেই কবেকার কথা! কিন্তু এমনই বিস্ময়ের ঘোর লেগেছিল যে আজও এই গল্পটা মনে আছে।
আর ক্লাশ সেভেন, এইট থেকে সেইসব ক্যাম্পের কথা? আমি রাজশাহী, ঢাকা যাওয়ার চান্স পেয়েছিলাম গার্ল গাইডস থেকে, রেড-ক্রস থেকে। গোপন খবর হ’ল আমাদের বাড়ির কড়া শাসনের পাল্লায় পড়ে স্বাধীন, উড়ন্ত বলাকা সুস্মিতার মত সিলেট, চিটাগাং যাওয়ার চান্স পাওয়া যায় নি!
একবার মাদার তেরেসা ঢাকায় এসেছেন। আমি রেডক্রস ক্যাম্পে। নিজের গায়ে আগুন না ধরিয়ে কী যেন একটা ডিম পেড়েছি না ডিম ওমলেট করেছি। পেয়ে ফেল্লাম মাদার তেরেসার হাত থেকে মেডেল। আজও সে মেডেল ফায়ার-প্লেসের উপর থেকে স্বপ্নের ভিতর ঝুলিয়ে রেখেছি।
রাজশাহীতে গার্ল গাইডস ক্যাম্প। আমরা ভালো ব্যাং ভাজতে পারি, আমরা ভালো ব্যাং-এর মত গলা সাধতে পারি, আমরা ভালো ব্যাং-এর মত লাফ দিতে পারি। এতই যে সব ভালো পারি, আমাদের দেখিয়ে আমাদের লাফ ঝাঁপ কে নিজের দেওয়া শিক্ষা বলে শেষমেষ আমাদের গাইড আপা অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। আমরা ব্যাং বাবাজীবন সব কূয়ার মধ্যে থেকে গেলাম। সে দুঃখের কথা নিঃশব্দে বুকে চেপে রাখাই ভালো। ‘গাইড দীপটি নিভাতে চাই, নিভাতে চাই।’
আর একবার। পি এন স্কুলে ক্যাম্প। টান্ টান্ তাঁবু টানানো হয়েছে। খবরের কাগজ বুনে বুনে মাটিতে বসবার ম্যাট ‘সীট-আপন’, রীফনট্, ফিশারম্যানস্ নট, রূপসী ফিগার এইট নট্ সব হাতে কলমে শেখা শেষ। রাত হ’য়ে গেছে। টেন্টের মেঝেময় খড় বিছানো। তার উপর নিজ নিজ হোল্ড-অল পেতে আমাদের বিছানা। হোল্ড-অল খুলতে গেছি, ‘ফোঁস’! ফনা তুলে গোখরা। খড়ের নীচ থেকে। বেচারা শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল। মাথায় খড়ম আঁকা।
‘কাট্, কাট্’, বান্ধবী সুস্মিতা এসে গেছে!
‘সব সবসময় গুল মারিস্ কেন? মোটেই গোখরা ছিল না। তুই নিজ চোখে খড়ম দেখেছিস্?’
যাহোক, সে রাতে আর টর্চ নিয়ে কেউ গোখরা বা পাইথন দেখতে গেল না। আমাদের টেন্টে শুতে দিল না। সোজা স্কুলঘরের মাটি।
বন্ধুগণ, এইসব অতীত কাহিনীর আরব্য রজনীর গল্প বলবার একটাই কারণ। তখনকার স্ট্যান্ডার্ডে অনেক পুতুপুতু ক’রে আমরা বড় হলেও ছেলেবেলায় এইসব ছোটাখাট এভারেষ্ট জয় করতে আমাদের বাবা মা কিন্তু দিয়েছিল। মে মাসে চোদ্দ বছর হ'বে হৈ-এর। তবে আমার কেন এই চরম দুরাবস্থা? শুধু আমাদের ছানাপোনাই আমাদের রক্তের সন্তান?
যাওয়ার আগে হৈ-এর প্রিয়তম বন্ধুর মা বলল, ‘এতগুলো টাকা হাতখরচ আর লাঞ্চ কিনবার জন্য দেব। একঘন্টার মধ্যে তো নিকোলাস সব হারিয়ে ফেলবে। একদম সম্ভব। উইস্কনসিনে কী বরফই না পড়ে। প্রায় হাঁটুসমান। বহুদিন দেখেছি স্কুলে যাওয়ার সময় শীতকালেও নিকোলাস এসেছে মোজা আর ক্লগ পড়ে। সমুদ্রসৈকত তো নয়! আসলে স্কুলের জুতা পড়তে ভুলে গেছে।
আমাদের হৈ-ও কম যায় না। নিজ স্কুলের বাইরে বেশ বড়সর এক পরীক্ষা দিতে যাবে। বারবার বলেছি ক্যালকুলেটর-টা মনে ক’রে বাড়ি এন। স্কুল কিন্তু সোমবার সকাল আটটার আগে খুলবে না। শনিবার পরীক্ষা। যথারীতি। পরীক্ষার আগের দিন রাত বারোটায় জানা গেল ক্যালকুলেটার বাড়ি আসেননি। ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী হ’য়ে তখন ক্যালকুলেটার কিনবার পালা! সকলের দাঁতে দাঁত ঘষা বন্ধ হ’লে,
‘স্কুলে, জিম সুর নীচে। ভালো ক’রে চাপা দিয়েছি। খুব সেফ।’ শুনলেই তো আমার মা হার্টফেল করবে। পড়াশোনার কোন জিনিষে জুতা ছুঁইয়েছ? আর আমি সেফটিনেটে সদ্য ধরা পড়া মাছের মত ছট্ফট্!ছোটবোন তাথৈ এটা এগিয়ে দেয়, সেটা এগিয়ে দেয়। শেষমেষ কাঠি, গুলি দিয়ে একটা এ্যাবাকাস বানিয়ে ধরিয়ে দেবে কিনা কে জানে। সব ভাই আর দাদাগুলোই বুঝি এমন বুদ্ধিমতী মাশার ভাই!
স্কুলের বই ভুলে স্কুলে এসে হাজির ভিতিয়া । ‘কী হবে এখন? ঘন্টা পড়ে গেল...দরজা খোলে-খোলে...’ ‘ববিক, রবিক, লবিক, জুবিক!’ ডাক পড়ল চার কুকুরের। তাদের মুখে বই খাতা গুঁজে দিল বুদ্ধিমতী মাশা। কী দৌড়, কী দৌড়। দিদিমণি আসবার একটু আগেই বই খাতা নিয়ে এসে হাজির কুকুরেরা। সাথে চিঠি। লেখা আছে, ‘তুই একটা ভুলো। তোর দিদি মাশা।’
কিন্তু গল্প তো গল্পই। নিকোলাসের মা’র চিন্তার কথা হৈ-কে বলতেই ততক্ষণাত্, ‘নট টু ওয়ারি। আই উইল স্ট্যান্ড বাই মাই ফ্রেন্ড!’ নিকোলাসের মা-কে সে কথা বলতেই হাসতে হাসতে, ‘নিশ্চয়!’
গাড়িতে ক'রে স্কুলে যাওয়ার পথে হৈ-এর নানা গল্প। পরে স্কেজুল দেখে কোন কোন জায়গায় যাবে শুনে আর উইকিপিডিয়া উল্টে জ্ঞান আমার আরো বেড়ে গেল।
শোনা গেল আছে নাকি টোয়াইলাইট ডিনার এন্ড ড্যান্স ক্রুজ। টোয়াইলাইটের আলোতে ড্যান্স করতে গিয়ে অজানা বনে বাবা ইয়াগা না তাড়া ক’রে! সে নাচ জানে না।
‘আমরা হোয়াইট হাউজ দেখতে যাব।’ বাহ্! বোঝা গেল হোয়াইট হাউজ-এর লোহার কালো বেড়ার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবার সুযোগ পাবে। দেখে ফেলবে স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়াম, নিউজিয়াম, লিঙ্কন মিউজিয়াম। আলবার্ট আইনস্টাইন মিউজিয়াম-ও ।
![]() |
আইনস্টাইনের হাত। ব্রঞ্জের পুরো মূর্তিটার ওজন ৪ টন। আইনস্টাইনের একশ’ বছরের জন্মদিনে উন্মোচন ক’রা হয় এই ১২ ফুট মূর্তি। |
যাওয়া আছে চায়না টাউনে। ইমিগ্রান্ট্দের গল্প সবসময় আমাকে এত মোহগ্রস্ত ক’রে! আমেরিকার প্যাচওয়ার্ক কুইল্টে এক একটা স্কয়ার ওরা। শুধু তো নিজেরাই আসে নি। সাথে এসেছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, নিজ নিজ ঘরের রান্নাগুলো, ঠাকুরদাদার গল্প, নাচ, গান। ফেলে আসা কান্না আর স্মৃতি। পাশের বাড়ির প্রিয় বন্ধু ডেবরা মাঝে মাঝেই আমাকে নানা রান্নার রেসিপি দিত। সুইডিশ পপি সীড কেক! একবার দেখি আমার জন্য একটা গাছের ছোট কাটিং নিয়ে এসেছে। ওর সুইডিশ গ্র্যান্ডমাদার যখন এ দেশে আসেন তখন একটা প্রিয় গাছ এনেছিলেন। হাউজপ্লান্ট। সেই গাছের কাটিং ক’রে ক’রে এত বছর। দুই পুরুষ আগে সুইডেন থেকে এসেছিলো ওরা।
পাশেই ফোর্ডস থিয়েটার। এখানে আমেরিকার প্রিয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন-কে গুলি ক’রে মারা হয়। লাইব্রেরী অফ্ কনগ্রেস দেখতে যাওয়া আছে। শোনা যায় এখন এটাই নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে আন্তর্জাতিক লাইব্রেরী।
শুনবে সিনেট আর হাউজ কমিটি হিয়ারিং। প্রায় একমাস ধরে ওরা প্রশ্ন তৈরী করছে। টিচারকে দেখিয়ে তা ঠিক করছে। সিনেটরদের সাথে যে দেখা করবে, কি জিজ্ঞাসা করবে তখন? সিনেটর ট্যামি ব্যাল্ডউয়িন(ডেমোক্র্যাট)-এর জন্য হৈ-এর প্রশ্ন ক্রামিয়ান যুদ্ধ নিয়ে। রিপ্রেজেনটেটিভ মার্ক পোকান-এর জন্য প্রশ্ন মারিজুয়ানা লিগালাইজেশন নিয়ে।
সুপ্রীম কোর্ট দেখা আছে, আছে ক্যাপিটাল ট্যুর। ওল্ড টাউন আলেক্সন্দ্রিয়া, ইউ.এস. ইন্সটিটুইট অফ্ পিস্, পেন কোয়ার্টার, কেনেডী সেন্টার, আর্লিংটন ন্যাশনাল সেমেটারী, ঘোস্ট এন্ড গ্রেভইয়ার্ডস ট্যুর, ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু মেমরিয়্যাল, জেফারসন মেমরিয়্যাল, ইও জিমা মেমরিয়্যাল,মেরিন কর্পস্ মেমরিয়্যাল - আরো কত কী!
সব চেয়ে বড় কথা ন্যাশনাল গ্যালারী অফ্ আর্ট দেখতে যাবে ওরা। মহা উত্তেজিত হ’য়ে পরে উইকেপিডিয়া থেকে আর গুগল ক’রে জেনেছি রাফায়েল, এল্ গ্রেকো, রেম্ব্র্যান্ডট্, ম্যনে, ম্যানে, ভ্যান গগ্, গগ্যাঁ, সেজান, মাতিস, পিকাসো, মেরী কাসাত্- আরো কত শিল্পীর অরিজিনাল পেন্টিং যে আছে ওখানে! এত সব ছবি? ভাবা যায়? আমার রাতের ঘুম গেল। যাক্ ফিরে এলে ‘বিলেত ফেরত ছেলে’-র মত বলতে পারব ‘আমার স্বর্গ ফেরত ছেলে’।
কোরিয়ান ওয়্যার মিউজিয়াম, ভিয়েতনাম ওয়্যার মিউজিয়াম দেখতে যাবে। জানাল, ‘ওখানে ওরা আমাদের আনবায়াসড্ ওপিনিয়ন দেবে।’
মনে মনে শুধু বললাম সব ছেলেমেয়েগুলোই যেন কোনো দেশে যা কেউ দেখাবে না, যা কেউ বলে দেবে না অথচ যা কিনা অন্য দেশের বুকের পাঁজর গুঁড়ো ক’রে দিয়েছে জীবনে তা খুঁজে পায়। রক্তের সমুদ্র এক নদীর জলে হ’য় না। নিজের বুদ্ধিটুকু দিয়ে যেন ওরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে হুকুমটা কোথা থেকে আসছে।
![]() |
ভিয়েতনাম ওয়াল – যত মানুষের নাম এখানে, খুঁজে পাওয়া যাবে না তত লাল গোলাপ |
এভাবেই ওরা বেড়ে উঠুক। এভাবেই ওরা বড় হ’য়ে উঠুক। মুক্ত বাতাসে। যেভাবে ভাবতে চায়, যা ভাবতে চায়, শিখুক - মানবতার সপক্ষে। বনের ভিতর ওই আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া, চারপাশ ছাপিয়ে পড়া ডগলাস ফারের মত। দুইশ’ ছেচল্লিশ ফুট লম্বা সেই গাছ। পাতায় পাতায় লকেটের মত বাদামী ‘কোন’ ঝুলে আছে। নরম ঝাউ পাতা। চোখের পাপড়িতে বোলাতে ইচ্ছা ক’রে। পাতার গায়ে খ্রিস্টমাসের গন্ধ। ঝিলিমিলি সাজ। কত যে প্রেজেন্ট ঝুলছে। কে যেন বলেছিল সবচেয়ে সুখী পাখি খ্রিস্টমাস ট্রি-তে বাসা বাঁধে। কিংবা হোক নাহয় বনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ওক গাছটা। চারশ’ বছর আয়ু।
পৃথিবীতে কয়টা বাচ্চা কিছু শিখবার সুযোগ পায়? আমাদের দেশে, ঢাকায় গাড়ির পাশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে থাকে হাতে বকুলফুলের মালা নিয়ে। দশ পয়সা ক’রে দাম। তাও যদি বিক্রী হয়! দাঁড়িয়ে থাকে ওরা ছোট ছোট বাগরী পাখি নিয়ে। খুব ঝাল দিয়ে কষিয়ে বাগরী রাঁধলে জিভ থেকে জল ঝরে, চোখ থেকে জল ঝরে। দাঁড়িয়ে থাকে চখাচখি নিয়ে। ঘাড় মুচরানো। একবার হৈ, তাথৈ-কে দেশে নিয়ে গেছি। ঘাড় মুচরানো চখাদের দেখে খুব অবাক হ’ল না ওরা। উইস্কনসিনে ঘাড় মটকানো হরিণ অনেক দেখেছে। Fall-এ পাতা ঝরার সাথে সাথে অনেক মানুষ ভোল পাল্টে শিকারী হ’য়ে গিয়ে বন্দুক কিংবা তীর ধনুক নিয়ে বের হ’য়। নিজেদের ট্রাকের পিছনে ক’রে শিকার ক’রা হরিণ নিয়ে যায়। হাইওয়েতে তাদের পাশে গাড়ী প্রায়শই চালাতে হয়। কিন্তু হৈ, তাথৈ খুবই আশ্চর্য হ’ল ঘাড় মুচরানো চখা বিক্রী ক’রা বাচ্চাগুলোকে দেখে।
‘ওদের জুতা নেই?’
জীবন কেটে যায়..................।
আমাদের দেশে পাতা কুড়াতে কুড়াতেই বাচ্চাগুলোর জীবন কেটে যায়।
একবার বান্ধবী সুস্মিতা (আসলে ও সুস্মি, আজকাল সম্মান দেওয়ার জন্য বান্ধবী সুস্মিতা বলে ডাকছি), অন্য কয়েকজন বন্ধু, আমি মিলে বিকেলবেলা পাতা কুড়ানো আর ঘুটে কুড়ানো বাচ্চাগুলোকে পড়ানোর জন্য একটা স্কুল খুলেছিলাম। লাইন ক’রে দাঁড় করিয়ে জাতীয় সঙ্গীত শেখানো।
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুর এবং গান। যতবার শুনি, যতবার গাই – চোখে জল আসে।
‘কী শোভা,
কী ছায়া গো,
কী স্নেহ,
কী মায়া গো,
কী আঁচল বিছায়েছ
বটের মূলে,নদীর কূলে কূলে।’
ওদের বর্ণমালা শেখাচ্ছি। চিঠি লিখতে শেখাচ্ছি – কোন ফাঁকি নেই আমাদের কাজে। তখনও বালিকা ছিলাম কি না! তাই। আর 'অ' 'আ' শেখানোই তো শুধু নয়। ওদের খাবার দিতাম। জামা কাপড় দিতাম। বাড়ি বাড়ি ঘুরে সব জোগাড় করতাম। কাঁকনের কী সুন্দর সুন্দর যে ভেলভেটের জামা ছিল। আমাদের দিল একটা মেরুন রঙ্গের ভেলভেটের জামা। সোণালি রঙ্গের জরির কাজ কোমরের কাছে। আর একটা শ্যাওলা সবুজ ভেলভেট। সে জামার গলার কাছে রূপালি জরি। এখনও বুকের ভিতর একটা নরম তুলো তুলো, তুলাপুটপুটি পাখির ভালোবাসা জেগে ওঠে ওই জামাদু'টোর কথা ভাবলে। টিয়া ছিল আমার প্রিয় ছাত্রী। ছয় সাত বছর বয়স। কী যে মিষ্টি! সবুজ জামাটা দিলাম। ওকে দেখতে একদম সত্যিকারের টিয়াপাখির মত লাগল।ভেলভেটের জামাটা পড়ে আমার টিয়া ঘুটে কুড়াতে থাকল।
প্রায় প্রতিদিনই বাচ্চাগুলো জিজ্ঞাসা করত। কি হ’বে লেখাপড়া শিখে? শুধুমাত্র জানার জন্য, সবকিছু কিভাবে হয় বুঝবার জন্য মানুষ পড়াশোনা করে। এ ভালোবাসা পৃথিবীর সব ভালোবাসার উপরে, সব থেকে দামী। অনেক পড়াশোনা করলে পিএইচ.ডি ডিগ্রী পায় মানুষ। আর মাঝে মাঝে কোন মানুষের জ্ঞান অন্য মানুষদের মাঝে এতটাই আলো দেয় যে তাঁদের নোবেল প্রাইজ দেওয়া হ’য় তখন। এ সমস্ত অর্থহীন কথার ওদের জীবনের কোথাও কোন জায়গা নেই দেখে ওরা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। আমরাও অমন করি। যখন ‘না’ বলতে চাই, ‘হ্যাঁ’ বলি।কয়েকদিন পর পরই পরীক্ষা নিতাম। পড়াশোনা শেখাটা তো ‘প্রিভিলেজ’ নয়। অধিকার।
প্রশ্নঃ বল তো পানি বানান কি?
উত্তরঃ ‘ভ’-এ আকার, ‘ত’।
স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।বাসে প্রায় উঠবে উঠবে করছে ওরা।
আস্তে ক'রে হৈ বলল, 'মম্, দে উইল টেক আস টু সী দ্যা হলোকস্ট মিউজিয়্যাম টু।' আনা ফ্রাঙ্ক?
এপ্রিল মাস হ'লেও উইস্কনসিনের সব বরফ এখনো গলেনি। খুব জোরে বাতাস দিল। এমন বরফ ঠান্ডা বাতাস যখন চোখের মণিতে গিয়ে ধাক্কা দেয়, চোখের কোণ থেকে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়ে।
বড় ভালো লাগলো, মউ এর লিংক থেকে পড়লাম। ভাল থেকো রমা। অদিতি দি
উত্তরমুছুনঅপূর্ব! আমিও মাঝে মাঝে ভাবি কেন অন্তত এতটুকু স্বাধীনতা দিতে পারি না মন খুলে যতটুকু আমি পেয়েছি। তবে এটাও জানি বাচ্চারা ঠিক নিজেদের দুনিয়াটা খুঁজে নেবে।
উত্তরমুছুনমন ছুঁয়ে গেল। সব বাবা মা কেই এ পথ পেরুতে হয়। তারপর একদিন সকালে দেখি আর কোন দায়িত্ব নেই...। ওরা বড় হয়ে গেছে......।
উত্তরমুছুন