সোনার কাঠি রুপার কাঠি
(মৌসুমী দত্তরায়-কে)
একুশে জুলাই, ২০১৪
অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।
রান্নাঘর থেকে ভুনা খিচুড়ি, কষা মাংসের গন্ধ ভেসে
আসছে। বৃষ্টি হ’লেই
খিচুড়ি খাওয়া – এ যেন ছেলেবেলায় মাথা থাকলেই ন্যাড়া মাথা করবার মত। করতেই হবে। আমি তো ক্লাশ
এইট পর্যন্ত আমার মাসীর অত্যাচারে ন্যাড়ামাথা ক’রে জবাফুলের পাতা বেটে মাথায় দিয়ে ঘুরেছি। ঘন চুলে লম্বা বিনুনী হ’বে। জানিয়ে রাখি অনেক খুঁজেও কোথাও কোনদিন আমার বিনুনী ক’রা একটা ছবি আমি দেখিনি। ‘সেথায়’ কেবল গন্ধরাজ তেল ফুটেছে। লুচি
ভাজা যাবে।
হ্যাঁ, ভুনা খিচুড়ি আর কষা মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে। তবে সত্যবাদী হ’য়ে জানাই আমাদের বাসায় খিচুড়ির সাথে আসলে বেগুনভাজাই বেশি হ’ত, মোগলাই মাংস পাওয়া যেত না। শুনেছি
গ্রামের বাড়িতে মুরগী নাকি রান্নাঘরে রান্নাই হ’ত না। দূরে একটা ঘর ক’রে নিয়ম না মানা
মামাদের দল মুরগীর মাংস রান্না করত। তাও তো হ’ত। আমার ঠাকুরদাদার
বাড়ির সবাই বৈষ্ণব বলে তারা তো মুশুরীর ডালও খায় না। ‘উহা’ আমিষ।
তবে এ কথা ঠিক মুরগী
বেশি না জুটলেও কপাল ভালো থাকলে, বাড়ির সবার মুড ভালো
থাকলে খিচুড়ির সাথে বাঁধাকপি বা ফুলকপির তরকারি পাওয়া যেত। মুরগির ঠ্যাং-এর
চেয়ে ফুলকপির ডাটা উপকারি!
এইসব বৃষ্টিভেজা দিনে
আমি সবসময় রূপকথা পড়তাম। দিদার শাড়ি দিয়ে বানানো কাঁথার তলে ঢুকে। আঁধো
অন্ধকারে, লুকিয়ে লুকিয়ে সন্ধ্যার সময়।
বারান্দায় লাল আর হলুদ সন্ধ্যামালতী ফুটত। সন্ধ্যামালতী ফুলে একটা হালকা মিষ্টি
গন্ধ।
পড়তাম ঠাকুরমার ঝুলি।
এতদিন সে কথা গোপন ক’রে নানা রকম আঁতলামি
দেখালেও আজ বলতে দ্বিধা নেই, আমি আসলে আঠারো বছর
বয়স পর্যন্ত বই-এর ভিতর রূপকথাই সবচেয়ে বেশি পড়েছি। এই পঞ্চাশ বছর ছুঁই ছুঁই
বয়সেও অর্জন সেই একই মেডেল। কোথাও কোন দেশের রূপকথা দেখলেই ছুটে যাই। সে যাদুকরী
ভাসিলিসাই হোক কিংবা রাজকন্যা কঙ্কাবতী। সেইসব ছেলেবেলার দিনগুলোতে রূপকথা পড়তে
পড়তে নিজেকেও কোন এক রাজকন্যাই মনে হ’ত আমার। মাথার কাছে
সোনার কাঠি, রুপার কাঠি। বদলে দিলেই ঘুম ভেঙ্গে যায়।
আর চেনা পৃথিবীটা পুরোটাই কিভাবে যেন পাল্টে যায়।
টংসা, সিম্বাকেও আমি সোনার কাঠি, রুপার কাঠি বলেই ডাকতাম। আমার প্রাণের দুই কুকুর। টংসার রঙ সোণালি মত বাদামি। সিম্বা দুধ শাদা। টংসা সোনার
কাঠি, সিম্বা রুপার কাঠি। মাথার কাছে আর পায়ের
কাছে সেই সে সোনার কাঠি, রুপার কাঠি নিয়ে বছরের
পর বছর ঘুমিয়েছি। রূপকথার জীবন।
আসলে ছেলেবেলায়
বাড়িতে অনেক ঝোলাঝুলি ক’রে ললিপপ কিনবার তাও
একটু অনুমতি মিললেও কোনদিন কুকুর, বিড়াল পুষবার অনুমতি
মেলে নি। ছোটমাসি অবশ্য একবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের দিন বলেছিল,‘যদি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে পারিস আর রাস্তার নেড়ি কুকুর দেখে ভয় না
পাস, তবে কুকুর কিনে দেব।’ আরে এ কথা তো আগে বলতে হয়। পড়াশোনা তো যা করবার তা কবরে
ঢুকবার মতই করা হয়ে গেছে। তবু যখন নেক্সট নেড়িটা আমাকে তাড়া করল কারো গাছের
লিচু কিংবা আম চুরি না করবার জন্য(এ কাজেও আমি ফেল), আমি একদম দাঁতে দাঁত চেপে বোঁচা নাকটা সোজা ক’রে শামুকের মত ধীরে ধীরে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। একটুও লেজ তুলে দৌড় দেওয়া মত ক’রে নয়। এদিকে কুকুর পাওয়ার লোভটা না জেনেই যা ছাইপাশ পড়াশোনা করেছিলাম তা
দিয়েই একটু বোর্ডে স্ট্যান্ডও ক’রে ফেললাম। জীবনে মেডেল
আমার জুটল, তবু কুকুর জুটল না। তাই আজ যদি কেউ আমায়
কুইজ দেয়, ‘বল তো, বিয়ে ক’রে তোমার কি লাভ হয়েছে?’ আমি সাথে সাথে উত্তর
দেব, ‘কুকুর পুষবার স্বাধীনতা!’ তাও একটা নয়, দু দু’টো। তবে এ বিষয়েও গল্প আছে।
তখন আমি খুব ‘বর্ন ফ্রি’, ‘লিভিং ফ্রি’, ‘ফরএভার ফ্রি’ পড়ছি আর দিন রাত
কাঁদছি। সিংহ মানুষ করতে পারব না ব’লে ভাবলাম বরং কুকুর
মানুষ ক’রে ফেলি। আর নাম রাখি এলসা। কিন্তু প্রথম যে কুকুর
আমার হৃত্পিন্ড খাবলে খেল কোন রকম আরগ্যের সম্ভাবনা না দেখিয়ে সে হ’ল এক শাদা রঙের জার্মান স্পিত্স্। ছেলে কুকুরের নাম তো আর ‘এলসা’ রাখা যায় না। কিন্তু তখন সিংহের মত
আমিও যেন ঘাড়ে কেশর ফুলাচ্ছি। অন্য আর কিছু নয়, কুকুরের নাম ‘নাম তার সিংহ’–ই হ’তে হ’বে। পোলার বিয়ার রাখলেই ঠিক হ’ত, তবু রেখে ফেলা হ’ল শাদা কুকুরের নাম ‘সিম্বা’। আমার পতিদেবতা তা শুনে হিংসায় সাত টুকরা। পরের সপ্তাহেই আবার চলল হাতিবাগান।
আর একটা কুকুর কিনে এবার নিজে নাম রাখবে। সোণালি-বাদামি কুকুরছানা এল। সে তার নাম রাখল
টংসা। ভূটানে নাকি একটা নদী আছে টংসা চু নামে। চু মানে নদী? তবে বড় হ’য়ে টংসা এত্ত বড় একটা
সাড়ে সর্বনাশ তৈরী হ’য়েছিল যে টংসা চু নদীর
নাম তাকে মানায় নি। কিন্তু নাম আর এফিডেভিট করা হয় নি।
হাতিবাগান থেকে কুকুর
কিনবারও অনেক গল্প। ইউ এস এ তে যেমন পাপিমিল আছে; আমার ধারণা হাতিবাগান-ও অনেকটা তেমন।
পাপিমিলে ছোট ছোট খাঁচার ভিতর থাকে কুকুরগুলো। কোন একভাবে অমানবিক, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শুধু ব্যবসার জন্য কুকুরের বাচ্চার জন্ম দেওয়া হয়
সেখানে। তারপর সেই তুলতুলে ভালোবাসা বেচে টাকা।
তবু প্রতি রবিবার আমরা
হাতিবাগানে যেতাম। অনেক অনেক কুকুরছানা, মাছ, পাখি, কচ্ছপ দেখে আমার চোখ চাঁদের আলোয় ভেসে যেত। মনে হ’ত ওদের সকলকেই বাড়ি নিয়ে আসি। চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলব
নাকি ঘরটাকে? এদিকে চিড়িয়াখানা আমার দু’ চোখের বিষ। আজকাল যাইও না দেখতে।
আর সেই যে। একবার একটা
নাইটজার পাখি কোথা থেকে উড়ে আমাদের বাড়ি এসেছিল। একটু চোট পেয়েছে মনে হয়
ডানায়। খুবই জুবুথুবু অবস্থা। চিড়িয়াখানা সাপোর্ট করিনা মানে পাখিকেও তো
খাঁচায় রাখা যাবে না। নতুন বিয়ে টিয়ে ক’রে তখন সল্টলেকে, এ এ
-১৭১ এ বিছানা বালিশ গুছাচ্ছি। রান্নায় ত আরো পারদর্শী। ডিম ওমলেট করতে গিয়ে
ডিমটা মাটিতে ফেলছি আর ডিমের খোসা তাওয়ার উপর।
নাইটজার পাখিকে ঘরের
ভিতর ছেড়ে দিলাম। ও ই বাড়িতে থাকে। আর আমরা মাথার উপর বালিশ দিয়ে ঢালের মত ক’রে ভয়ে ভয়ে ঘরের ভিতর
ঘোরাফেরা করি। পাখি আর পোকা মাকড় ভালোবাসলেও ডানার ঝাপটায় তখনও ভয়। একদিন রাতে
ঘুম ভেঙ্গে গেছে। এ ঘর থেকে ও ঘরে জল খেতে যাব, দেখি
অন্ধকারে ছোট ছোট আগুনের গোলার মত লাল চোখ। ওহ্, তার মানে ও
রাত জাগা পাখি? জেগে উঠে আমাদের পাহারা দিচ্ছে? তারমানে ডানায় চোট নেই? রাত জেগে দিনে ঘুম পাচ্ছে
বলেই জুবুথুবু, ঢুলুঢুলু অবস্থা ? আর
আমি তাকে পাকড়ে ধরে উপকার করবার চেষ্টা করছিলাম ডানার যত্ন নিয়ে?
বাড়িটাকে সাফারি
বানানো আমার সেখানেই শেষ।
২২শে জুলাই, ২০১৪
টংসা তো এল। কিন্তু ওর
পেডিগ্রির কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। আজ থেকে আঠারো বছর আগে হাতীবাগানে ওকে
গ্লোডেন রিট্রিভার বলে আমাদের কাছে বেচেছিলো এক অতি চালাক বাঙালী। বিক্রেতা
সান্ত্বনার সুরে এও বলেছিল, ‘নিয়ে যান, যদি ছয় মাস পরে ভালো না
লাগে, ফেরত দিয়ে দেবেন। আমরা নিয়ে নেব। ’ কুকুর যখন কেউ বাড়িতে নিয়ে আসে, তাকে তো প্রাণ
দিয়ে ভালোবাসে। বিছানা বালিশ কুটি ক’রে ফেললেও তাকে কি কেউ
ফেরত দিতে পারে? বিক্রেতা ভালোভাবেই তা জানত।
কিন্তু ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ কথাটা এবং ছেলেবেলার
হিতোপদেশ পড়া জীবনকে যদি সম্মান করে চলতেই হয়, তবে স্বীকার করে ফেলা ভালো যে টংসা আমার প্রাণ সব সময়ই বন জংগল থেকে রিট্রিভ
করে আনলেও ও আসলে ছিল কোলকাতা কিংবা ভূটানের নেড়ীর ক্রস। জাত পাতের হিসাব আমি
কোনদিনই করি নি। মানুষেরই করি না, কুকুরের তো নয়ই। মাঝে
মাঝে ভাবি শুধুমাত্র এই কুকুর প্রানীটির জন্যই হয়ত আজো আমি রাস্তাতে হাঁটতে
ভালোবাসি। সে খালি পায়েই হাঁটি আর জুতা পরেই হাঁটি, রাস্তার সব কুকুর চিরকাল লেজ নেড়ে নেড়ে আমার পিছু পিছু। আর আমিও মানুষজনের
সাথে কথাবার্তা থামিয়ে ওদের দিকে জুলজুল চোখে, জিভ বের করে...। লেজ
কাটা ডোবারম্যান পিন্সচার, রটওয়েলার, কালো এলসেশিয়ান, পিটবুল, গায়ে ঘা হওয়া রাস্তার নেড়ী সবাই আমার বন্ধু। সব সময়ই
মানুষের থেকে বেশি বুঝতে পারি যেন ওদের কথা আমি। এখনও মনে পড়ে আমার বন্ধুর প্রথম
বাচ্চা দেখতে যাওয়ার ঘটনা। ভারী সুন্দর মেয়ে হয়েছে। একদম নরম তুলতুলে। দেখে টেখে আমি খুব খুশী। কিন্তু
বলে ফেললাম, ‘সবই তো খুব ভালো। শুধু লেজ নেই।’ বন্ধু আমায় মারে
নি। আসলে ততদিনে টংসা, সিম্বা এসে গেছে আমার
সংসারে। আর লেকটাউনে সোনার সংসার ভেসে যাচ্ছে ওদের জন্য ক্যারট দেওয়া সেরিল্যাক
কিনে।
আমার বাড়ি লোকজনের আসা
যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, কেননা আমার কুকুর নাকি
বুনো। ‘নো’ , ‘সিট’, ‘স্টে’ কিছুই তারা বোঝে না। আরে ভাই মানুষকেই সারাদিন কানের কাছে
ওঝা পড়া পড়ে মনুষত্ব দেওয়া গেল না আজও, এখন কুকুরকে মানুষ করে
আর লাভ কি? তাই সে চেষ্টার ধার পাশ দিয়েও আমি কোনদিন
যাইনি।
২৩শে জুলাই, ২০১৪
সিম্বার পেডিগ্রি ভালো।
তাই আমার সবসময় মনে হ’ত টংসাটাকে একটু আগলে রাখতে হবে। সিম্বাকে তো সবাই বিলাতি
কুকুর ব’লে বিলাতি বেগুন মানে লাল টুকটুক টমেটোর মত এমনিতেই
আদর করবে। এদিকে গোল্ডেন রিট্রিভার ব’লে গছিয়ে দেওয়া হ’লেও টংসা বেচারা তো আমার আসলে এক উচ্চশিক্ষিত নেড়ি! তার উপর আবার এলো যখন,
দেখি আহা রে, কী ভীষণ নাদুস নুদুস পেটলু।
মোটকা সোটকা বাচ্চা আমার খুবই পছন্দ। মানুষেরও। যেন আর চিন্তা নেই। সংসারে সব ঠিকমত
চলছে। বাবা, মা-র মধ্যে কোন ঝগড়া নেই। শ্বশুড়, শাশুড়ি গোপনে গোপনে খোঁচা দিয়ে কথা ব’লে পায়ের
নীচের মাটি সরিয়ে দিচ্ছে না। পাড়া পড়শিও তাদের ছেলে মেয়ে সম্মানীয় বেলতলা
কলেজে পড়বার চান্স পেয়েছে ব’লে দেখা হ’লেই গর্বের হাসি শেয়ার করছে না। এইসব জাগতিক কোন কিছু নিয়ে খুব মাথা
ব্যথা নেই ব’লে মা-পাখি ছানাগুলোকে খাইয়ে দাইয়ে
স্বাস্থ্যবান ক’রে তুলছে। দুধ, ফল,
গাজর।
কিন্তু নতুন কুকুর
আসবার পরের প্রথম বেবী চেক আপে ডাক্তারের কাছে নিতেই উনি মাথা নেড়ে বললেন, “ওর পেট ভর্তি ক্রিমি! ওর
ডিওয়ার্মিং করতে হ’বে।” তারপর
ডিওয়ার্মিং করতেই মোটকা সোটকা ছানা আমার চুপসে কাঠি।
কোলকাতা নিউমার্কেটের
পিছনে একটা বাজার ছিল। কত রকমের জিনিষ যে পাওয়া যেত। সেখানে দেখি বেতের বোনা ভারি
সুন্দর ডগ বাস্কেট। যা কিছু হাতে বোনা, তা সবসময়ই আমার মন কেড়ে নেয়। যেন ইঞ্চি
ইঞ্চি ভালোবাসা দিয়ে বুনেছে। কিন্তু বাস্কেটের দাম পাঁচশ টাকা। আঠারো বছর আগের
কথা। এখনও দামটা মনে আছে। কেননা তখন আমরা মাত্র সংসার পেতেছি। পাঁচশ টাকা দিয়ে
বাস্কেট কিনবার মত পয়সা ঠিক ছিল না। দু’ তিনবার গিয়ে দেখে
এলাম। তারপর কিনে ফেললাম।
ভালোবাসার জন্য কোনদিনই কোন দাম আটকায় না। টংসা, সিম্বা ওখানে ঘুমাবে। আমাদের শোওয়ার
ঘরে বিছানার পায়ের কাছে মাটিতে ওদের বাস্কেট রাখা হ’ল। নরম কাঁথামত বিছিয়ে দিয়েছি সেখানে, যেন কষ্ট না পায়।
কুন্ডুলি পাকিয়ে ঘুমাতে ব্যথা লাগে নিশ্চয়! আমার তো পদ্মাসনে বসতেই মাথা ব্যথা হ’য়ে যায়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই টংসা, সিম্বা
বাস্কেট ছেড়ে আমাদের মশারির ভিতর। লেকটাউনে যে অনেক মশা!
বাড়িতে ছোটবাচ্চা যখন
হাঁটতে শেখে, বাবা
মার যেমন সতর্কতা, টংসা সিম্বাকে নিয়ে আমাদেরও তাই।
বারান্দার ফাঁক দিয়ে যেন পড়ে না যায়। ফ্রিজের তার দাঁতে কাটতে গিয়ে যেন শক্
না খায়। ফ্রিজের চারপাশ বক্স দিয়ে দিয়ে ঘিরে ফেললাম্ যেন ডিঙ্গাতে না পারে। আর
আমি প্রত্যেক দিন, প্রত্যেক সপ্তাহে কত ব’ড় হ’ল টংসা সিম্বা সেই ছবি দিয়ে এলবাম ভরে কোথাও
যেতে হ’লে তা ভ্যানিটি ব্যাগে করে নিয়ে যেতে শুরু করলাম।
দেখাতে হবে না আমার কৃতিত্ব? কেমন বাচ্চা মানুষ করছি?
টংসা সিম্বার মজার মজার
গল্প আর আমার নানা ন্যাকামো লিখতে গিয়ে চোখ জলে ভিজে আসছে। এত বছরেও চোখের
জল এক ফোঁটা শুকায় নি। ভালোবাসা যে কোনদিন মরে না। আমার টংসা বারো বছর বেঁচেছিল।
সিম্বা ষোল। ওরা মানুষের মত তো আশি বছর বাঁচে না। কি জানি অল্পদিন বাঁচে বলেই হয়ত
অমন দেবদূতের মত হ’য়। একদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত তিনটা হ’য়ে গিয়েছিল আমাদের। টংসা সিম্বা দরজার কাছে বসে আছে। কিচ্ছু খায় নি।
অপেক্ষা করছে। একে ভালোবাসা বলে। টংসার বোন ক্যান্সার হয়েছিল। সিম্বার পেটের
ভিতরও একটা টিওমার। মানুষের এমন মরণরোগ হ’লে তাও অল্প কিছু চিকিত্সা হয়। পশু পাখির না।
২৭শে জুলাই, ২০১৪
চোখের জলে নাকের জলে
ভেসে গত কয়দিন আর টংসা সিম্বার গল্প লিখতে পারিনি। প্রথম এ্যাটেপ্ট ফেল। রুমাল, বালতি পাশে নিয়ে আজ আবার
লিখতে বসেছি।
তখন টংসা, সিম্বা দু’ জনই খুব ছোট। এদিকে আমরা ভাবছি আর এই ইন্ডিয়াতে, সল্টলেকে
কাজ করব না। এবার একটু বাড়ি ঘর ছেড়ে বিদেশ যাব। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা
ভাবলাম। চাকরির ইন্টারভিউ দিলাম। হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়া যাওয়া
যায়। কিন্তু সেখানে টংসা, সিম্বা-কে ছয় মাস কোয়ারেন্টাইন
ক’রে রাখবে। ওরা বাঁচবে? আমাদের ছাড়া
এক রাত কাটায় নি। ইংল্যান্ডের-ও সেই একই অবস্থা। দেখা গেল আমেরিকায়
কোয়ারেন্টাইন করবার কোন উপদ্রব নেই। তবে সেখানেই চল। আমাদের ভেট বলল, ‘ওরা এমন কোন ভালো জাতের কুকুর তো নয়। আমেরিকায় কত ভালো ভালো কুকুর
পাওয়া যায়! ওদের নিয়ে যাওয়ার তো কোন দরকার দেখছি না।’
অনেকে যখন বাচ্চা এডপ্ট
ক’রে,
বিশেষতঃ আমাদের দেশে, পাড়া পড়শি আত্মীয়
স্বজন সবাই বলে, ‘আহা, বাচ্চাটার কী
ভাগ্য!’ ভাবে না, ‘আহা, বাবা মার কী ভাগ্য! এমন একটা বাচ্চা ওদের জীবনে এসেছে।’ আমাদেরও সেই একই অবস্থা। ভাগ্য ফেলে এক পা নড়তে পারলাম না। ঠিক হ’য়ে গেল টংসা, সিম্বাও আমাদের সাথেই চিরদিনের জন্য
আমেরিকা যাবে। তা সে নেড়িই হোক আর ফুলের কেয়ারিই হোক।
যাকে ভালোবাসি তাকে একা
ফেলে চ’লে যাব,
এতটা মানুষ যেন আমরা কোনদিন না হই।
২৮শে জুলাই, ২০১৪
লেকটাউনে তখন আমাদের
গাড়ি ছিল না। কিন্তু কোন এক আত্মীয় মনে হ’য় চলে যাওয়ার আগে দেখা করতে গাড়ি ক’রে বেড়াতে এল। তাকে বলে টংসা সিম্বাকে নিয়ে নিউমার্কেটে গেলাম। একটু
চলন্ত কিছু চড়া অভ্যাস করুক। কিভাবে নয়ত এত লম্বা জার্নি করবে? আমার হাতের পাতায় শরীর ছুঁইয়ে টংসা, সিম্বা গাড়ি
চড়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল।
কুকুরদের সার্কাসের মত ট্রেনিং
দেওয়ার আমি ঘোর বিরোধী। আমার কুকুরও তাই উড়ন্ত বলাকা। কিন্তু লাল বলল অল্প
স্বল্প ভদ্র না হ’লে প্লেনে হয়ত নেবে না। বাড়িতে ট্রেইনার রাখা হ’ল। তারা কুকুরকে হ্যান্ডশেক করতে শেখাল। টংসা সিম্বার প্রাণ থেকে সে
অবমাননা মুছে দেওয়ার জন্য বাকি জীবন আমি ওদের যা খুশি করতে দিয়েছি। কেবল মানুষ, খরগোশ, পাখি কামড়া্নো বারণ।
কিন্তু যাবে যে তার
বাক্স কই? প্লেক্সিগ্লাস টাইপ একটা জিনিষ দিয়ে
বাক্স বানানো হ’ল। ভাবলাম সেটা হয়ত
হাল্কা হ’বে। জানতামও না যে কাঠের বাক্স ভারি হ’লেও তাতে করে কুকুর নেওয়া যায়। তবে চলে যাওয়ার আগে একজন মাসি আমাদের বাড়ি
দেখা করতে এসে ভুল ক’রে সেই বাক্সের উপর বসে
পড়লেন। বাক্স ভেঙ্গে গেল। তাও ভালো। আগে ভাঙল। যদি টংসা, সিম্বাসমেত প্লেনে তুলতে গিয়ে ভাংত? ওরা তো মেঘের কুচি হ’য়ে ঝরে পড়ত। এবার
কুকুর ট্রান্সপোর্ট হ’বে কিভাবে? কেএলএম এয়ারলাইন্সের অফিসে গেলাম। গিয়ে দেখি ওদের
এয়ারলাইন্স এপ্রুভড চমত্কার বাক্স আছে। আগে জানলে বাক্স বানানোর এত কান্ড করবারই
দরকার হ’ত না।
কিন্তু দাম ভালোই। দু’শ ডলার মত
দাম পড়ল বাক্সদু’টোর। নতুন কচি চাকরি, ডলারে ভেসে যাচ্ছে না ব্যাঙ্ক, দু’শ ডলারও অনেক মনে হ’ল।
একজন খবর দিল ওদের নিতে
হ’লে এয়ারপোর্ট থেকে সার্টিফিকেট নিতে হ’বে। গেলাম। গিয়ে দেখি দমদম এয়ারপোর্টে তেমন কোন অফিস নেই। আরো খবর পেলাম, আমেরিকাতে কোয়ারেন্টাইন ক’রা নেই ঠিকই, কিন্তু এয়ারপোর্টে যদি
পরীক্ষা ক’রে দেখে যে কুকুর ওদেশে ঢুকবার উপোযোগী নয়, তবে পত্রপাঠ ফেরত পাঠিয়ে দেবে। কোথায় পাঠাবে? কার কাছে?
আমাদের চেনাশোনা কেউ
আমেরিকা কুকুর নিয়ে যায়নি। কিছু নিয়মই ঠিকমত জানি না। সব ধোঁয়া ধোঁয়া। অবস্থা
অনেকটা আমার ছেলেবেলার মতই। বাবা, মা ইংল্যান্ড যাবে।
পিএইচডি করবার ব্যাপার আছে। তাও আবার অতি ঠান্ডার নিউ ক্যাসেলে। আমাদের কোন
আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব তখন
ইংল্যান্ড যায়নি। সাতচল্লিশ বছর আগের কথা। জজসাহেব যে দাদু, তার বন্ধুবান্ধব, বন্ধুবান্ধবের আত্মীয়
স্বজনও না। অনেক আলোচনা ক’রে ঠিক হ’ল এত ছোট বাচ্চাকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই। দেশে তো আর আদর যত্নের
অভাব পড়েনি। আমি থাকলাম মামা, মাসী, দাদু দিদার কাছে। ছোটমাসী তো পুতুল খেলা ছেড়ে দিল।
রিপ্লেসমেন্ট এসে গেছে। প্রত্যেকদিন একটা ক’রে জামা বানাত আমার
জন্য। নয়মাস
বয়সে হাঁটতে শিখেছিলাম আমি। কিন্তু মা যখন সাড়ে তিন বছর পর ফিরে এল, দেখে আমি চার মামা মাসী, দাদু, দিদা, পাড়া পড়শি, আত্মীয় স্বজন আর জজসাহেবের নাতনী হ’য়ে দাদুর আর্দালিদের কোলে চড়ে পৃথিবী ঘুরে হাঁটতে ভুলে গেছি। অতি আহ্লাদে
সেই যে তখন মাথাটা আমার নষ্ট হ’য়েছিল, আজও সারে নি।
টংসা সিম্বার পাঁচশ
ডলার ক’রে প্লেন ফেয়ার। লালের কোম্পানি দেবে বলেছে। সেই কোম্পানিই
সব ব্যাবস্থা করছে কুকুর নেওয়ার। আমরা যে বলেছিলাম, ‘পুরো ফ্যামিলি না নিয়ে তো যেতে পারব না।’ আমেরিকান কোম্পানি
একবারও অস্বীকার করল না, দ্বিতীয় প্রশ্ন করল না
ফ্যামিলির সদস্য সংখ্যা নিয়ে। সালটা ছিল ১৯৯৭। সফ্টওয়ার লাইনে এ দেশে আসাটা
তখনও খুব জটিল হ’য়ে যায়নি। কোম্পানিই
বলল প্রাণী নেওয়ার পক্ষে কেএলএম সবচেয়ে ভালো এয়ারলাইন্স। খুব যত্ন ক’রে নিয়ে যাবে। আমাদের আসবার কথা ডিসেম্বরের শেষে। যাব ম্যাডিসন, উইস্কনসিন। ওখানে পোলার বিয়াররা থাকে! এদিকে শুনতে পেলাম
এয়ারলাইন্সের নিয়ম হচ্ছে মাইনাস দশ ডিগ্রী ফারেনহাইট(মাইনাস তেইশ পয়েন্ট থ্রি
থ্রি থ্রি ডিগ্রী সেলসিয়াস)-এর নীচে টেম্পারেচার ঘোরাফেরা করতে থাকলে ওরা প্রাণী
ট্রান্সপোর্ট ক’রে না। কোম্পানিকে
জানিয়ে দিলাম ডিসেম্বরে আসতে পারছি না। জানুয়ারি তো উইস্কনসিনে আরো সাংঘাতিক।
সীলমাছ সাঁতার কাটতে ভুলে যায়, পেঙ্গুইন হাঁটা।
জানুয়ারিতেও আসা হ’ল না। আমরা এদিকে যে
অমূল্য রত্ন! কোম্পানি জানাল, ‘তোমরা সত্যি সত্যি আসবে
তো?’ দোনামনা ক’রে ঠিক হ’ল ফেব্রুয়ারিতে চেষ্টা ক’রা যাক।
ওদের গলায় কলার ছিল
না। বন্দী বন্দী অফিসজীবি মনে হ’য় তেমন টাই পড়ালে
আমার। কিন্তু যাবে ব’লে কলার কিনে আনলাম।
পিতলের নেমট্যাগ এল। তার উপর সুন্দর ক’রে খোদাই ক’রা আমাদের
ই-মেল আইডি। তখনও যে আমাদের কোন ঠিকানা নেই আমেরিকাতে। ভাবখানা যেন ওরা হারিয়ে
গেলে কেউ আমাদের ই-মেইল ক’রে দেবে। শেষ পর্যন্ত
যে ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’
নিউমার্কেটের কাছের কুকুরের
দোকান ‘করোনা’ থেকে কুকুরের ওভারকোট কেনা হ’ল। বরফে হাঁটবার জুতা খুঁজে পাওয়া গেল না ব’লে ননদকে ফোন ক’রে জানালাম জুতা কিনে
এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসবি। ওরা তখন ম্যাডিসনে থাকে।
‘দুটো কুকুরের বুটজুতোর দাম ষাট ডলার। কিনব?’
‘এ আবার একটা প্রশ্ন হ’ল? নিশ্চয়ই কিনবি।’
এ দেশে আসবার বহু বছরের
পরে আমি নিজে ষাট ডলার দামের জুতা পড়েছি।
৮ই ফেব্রুয়ারি রওয়ানা
দিলাম। গভীর
রাতে ফ্লাইট। বাংলাদেশ বা ইন্ডিয়া সব জায়গা থেকেই দেখেছি অনেক রাতে বিদেশে
যাওয়ার ফ্লাইটগুলো থাকে। রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া? ব্রেন যদি ড্রেনেই পড়বে, রাতেই পড়ুক। আমাদের সুটকেস চারটা। হ্যান্ডলাগেজ দু’টা, কুকুরের বাক্স দু’টা। পাসপোর্টের জন্য কালো রঙের চামড়ার আট
ইঞ্চি ব্যাগ পেটে বাঁধা। শেষ কখন কি খাওয়ানো হয়েছে তা লিখতে হ’য় বলে টংসা সিম্বার বাক্সে আমরা কাগজে লিখে চিটিয়ে দিলাম, ‘মুরগীর মাংস, গাজর, মটরশুঁটি, ভাত।’ আমরা যে নীল রঙ্গের কম্বল গায়ে দিতাম তা দু ভাগ ক’রে টংসা সিম্বার বাক্সে পেতে দিলাম। যেন ভয় না পায়। যেন আমাদের গায়ের গন্ধ
ওদের কাছে কাছে থাকে।
ছেলেবেলার প্রিয়
রাশিয়ান বই ‘মালপত্র’-র কথা মনে পড়ল। আমাদের সুটকেসে্র ভিতর আবার আমি আর
লাল নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান ক’রে যে সাত কেজি (সুযোগ
পেলে সময়মত সব ভার-ই ওজন ক’রে নিতে হ’য়) পত্র লিখেছি তা ভরলাম। জীবনের ধন কিছুই ফেলে যাব না। জামা কাপড় বেশি নিই নি।
বরফের দেশে তো জামা কাপড় লাগে না। সুটকেস বোঝাই বাংলা বই। কান্নাকাটি করবার সময়
সাথী হিসাবে তো আর ওদেশে জীবনানন্দ দাশের কবিতা খুঁজে পাব না। সুটকেসে আরো ঢুকল
নানা লোকের বুদ্ধিতে একটা কড়াই, একটা প্যান, একটা হাড়ি, দু’টো খন্তা, একটা বিছানার চাদর। নেমেই নাকি এসব কিনতে
পারব না। সাথে নেওয়া হয়েছে আটশ’ ডলার। প্রথম মাসের বেতন
এক মাস পরে পাওয়া যাবে। মাটিতে শুয়েই কতদিন কেটে গেল আমেরিকাতে। বিছানা কিনবার
পয়সা নেই। শূন্য থেকে জীবন শুরু, খাওয়ার টেবিল নেই।
সাথে আছে শুধু দুই রাজকীয় কুকুর। আর কচুরীপানা ফুলের রঙ্গের হিউনডাই গাড়ি।
আমাদের জাগুয়ার!
যাত্রা শুরু করবার আগেই
পৌঁছানোর গল্প বলছি। আবার রিওয়াইন্ড ক’রি।
গভীর রাতে এয়ারপোর্টে
তো দাঁড়িয়ে আছি। পোর্টারগুলো আমাদের কুকুর বিড়াল নিয়ে এয়ারপোর্টের মেঝেতেই
রাজত্ব খুলে ফেলা দেখে অনেক ‘রুপি’ বকশিস্ হেঁকে ফেলল।
ডাক্তারের কথামত টংসা সিম্বাকে এত লম্বা জার্নির জন্য সিডেটিভ দিলাম। আমার তাতেও
ভয়। যদি আর ঘুম না ভাঙ্গে।
মালপত্র তোলা , নামানোর লোকগুলো কানের কাছে ঘ্যাঁনঘ্যাঁন ক’রে বিশুদ্ধ উচ্চারণে বলে চলেছে,
‘দিদি, কুকুরগুলোর কী ভাগ্যি মাইরি! আমরা যেতে পারলুম না, দেখুন দিকি এরা কেমন চলেচে। বেশি কিচু চাইনা। পরের জম্মে আপনার কুকুর হ’য়ে যেন জম্মাতে পারি।’ একজন তো আবার বীর দর্পে
এগিয়ে এসে মাঝরাতের দমদম এয়ারপোর্ট কাঁপিয়ে দিয়ে আমাকে জানিয়ে গেল, ‘ আমি পাঁচ বছর আগে একটা কুকুর এমন পার করেছিলাম।’ তার রেজিউমে শুনে আমার হাঁটু কেঁপে উঠল।
২৯শে জুলাই, ২০১৪
আমার পক্ষে টংসা
সিম্বার কথা লেখা খুব সোজা কাজ নয়। যখনই লিখছি ওদের বাক্সে চিটিয়ে দিয়েছি
মুরগির মাংস, মটরশুঁটি,
গাজর, ভাত, চোখের সামনে
ভেসে উঠছে ছোট্ট টংসার মুখ। পা টা একটু বেঁকিয়ে দাঁড়াত টংসা খাওয়ার সময়। কী
ভীষণ যে খুশি খাবার পেয়ে। ল্যাপল্যাপ ক’রে চেটেপুটে গোলাপি
জিহবা দিয়ে চোখের নিমিষে স্টিলের বাটি খালি। টংসা সিম্বার জিহবা খুব নরম, ভিজে ভিজে আর গরম মত ছিল। আমি কী ভীষণ ভালো যে বাসতাম যখন ওরা আমার চোখ
মুখ চেটে দিত। ২০০৮ সালে টংসা চলে গেছে, ২০১২ সালে সিম্বা।
এখনও একটু ঘুরে দাঁড়ালে ওদের দেখতে পাই। এখনও গালের উপর, হাতের
তালুর উপর ভেজা ভেজা। ওরা চেটে দিয়েছে।
একটু থামতে হচ্ছে
নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। আসলে কাউকে ভালোবাসলে সে যখন থাকে না, তার কথা ভাবতে নিলেই দমটা
বন্ধ হ’য়ে আসে। হাত দু’টো জড়ো ক’রে চুপচাপ একটু বসে থাকি। তারপর আবার লিখব।
টংসাটা যখন এসেছিল ওর
বয়স মাত্র দশ বারোদিন ছিল। লালের হাতের পাতার ভিতর ওর পুরো শরীরটা এঁটে যেত। চোখ ফুটেছে মাত্র, কিন্তু নিজে একা একা বাটি
থেকে চুকচুক ক’রে দুধ খেতে পারে না। আমরা ঝিনুক বাটির মত ক’রে একটু একটু ক’রে ওকে গরুর দুধে জল মিশিয়ে খাইয়ে
দিতাম। ছয় সপ্তাহের আগে কুকুরছানাকে মা-র কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার নিয়ম না
থাকলেও টংসাকে নিয়ে মনে হ’য় ওদের খুব বেশি তাড়া ছিল। যত
দেরি ক’রা যাবে, তত নেড়িত্ব বেড়িয়ে
পড়বে যে! সিম্বাদাদাও টংসাকে খুব আগলে রেখেছিল। সেই প্রায় জন্ম থেকেই ওরা একজন
আর একজনের সাথী। ওদের তো অফিস যাওয়া ছিল না, সকার খেলাও ছিল
না। প্রতিটা মূহুর্ত একসাথে কাটিয়েছে। আমরা মানুষেরা এতটা সময় একজন আর একজনের
সাথে কাটাই না। আমাদের যে কাজ আছে, আমাদের যে ব্যস্ততা আছে ।
প্লেনে উঠবার প্রায়
সময় হ’য়ে
গেছে। এটাই শেষ দেখা কিনা জানি না, ওরা এই লম্বা জার্নিটুকু
টিকবে কিনা জানি না। দেখা করতে গেলাম। এ কি? টংসার কেনেলের
দরজার ল্যাচ লাগানো নেই। আজো ভাবলে গাটা শিউরে ওঠে। আমি সেদিন সেখানে আর একবার
ওদের শেষ দেখা দেখতে না গেলে কি হ’ত? ওভাবেই
প্লেনে? তারপর? পাঁচ বছর আগে একবার
একটা কুকুর পার করবার লোকটার গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল।
গুডবাই ব’লে এলাম, কিন্তু চোখের জল শুরু হ’ল। প্লেনে পড়বার জন্য কিছু
গল্পের বই এনেছিলাম। কিন্তু কোথায় কি? পাহাড়, পর্বত, সাগরের উপর দিয়ে আমি উড়ে চলেছি, চোখের জলে নৌকা বেয়ে বেয়ে। এয়ারহোস্টেসকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘একবার একটু দেখা যাবে কি ওদের?’ খুব বিনীত উত্তর,
‘আসলে ওরা প্রেসারাইজড্ কারগো স্পেসে আছে। ওখানে তো যাওয়া যাবে
না। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই। ওরা ভালোই আছে।’
অনেক সময় সান্ত্বনা
বাণীতে কান্না থামে না। লাল এয়ারহোস্টেসের থেকেও বিনীত স্বরে বলল, ‘এতটা লম্বা পথ। ফোঁপানো
নিয়ে চলা তো একটু মুশ্কিল।’ বাধ্য ছাত্রী আমি তারপর অল্প
অল্প ফ্যাঁচফ্যঁচ প্রকাশ্যে করলাম, বাকিটুকু বাথরুমে ঢুকে
হাউমাউ ক’রে।
ওরা বলেছিল আমস্টারডামে
নাকি কুকুরদের বের ক’রে হাঁটাবে। অল্প কিছু খেতে দেবে। প্লেন থামতেই আমরা তো ছুটে
গেলাম। যদি দেখা মেলে। কিন্তু বুথে কেউ বলতে পারল না কোথায় ওদের দেখা যেতে পারে।
কুকুরের দেখা মিলল না ব’লে বাকি সময় মানুষ দেখে কাটালাম। যে
কোন ইউরোপিয়ান এয়ারপোর্টে দেখবার অনেক কিছু আছে। ওরা ঠিক কন্জারভেটিভ মত নয়।
ফ্যাশন সেন্স-ও চমত্কার! পরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি আমেরিকাও এ বিষয়ে এখনও বোরখা
পড়া।
অবশেষে শিকাগো
এয়ারপোর্টে প্লেন থামল। জীবনে আমি কোনদিন কোন দৌড়ে কোন পুরস্কার পাই নি। অথচ
সবসময় ভাবতাম স্পোর্টসেও আমি প্রথম পুরস্কার পেয়ে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে মেডেল
নিয়ে উঠব। বিস্কুট রেসে আমি তো আকাশের দিকে তাকিয়ে লাফাচ্ছি। দড়িতে বিস্কুট
ঝুলছে। আর মাথার ভিতর মেডেল। ফেরদৌসী আপা আমার মুখে দু’টো বিস্কুট গুঁজে দিয়ে বললেন,
‘রমা, সবাই তো মাঠ খালি ক’রে চলে গেছে!’ ভিকট্রি স্ট্যান্ডে যারা উঠেছিল, তাদের নামও শুনতে ইচ্ছা করল না।
আমার প্রাণের বন্ধু
আমায় বলল, ‘যে
মেমরী দৌড় হ’য়, তাতে নিশ্চয়ই তুই
পারবি।’ হ্যাঁ, প্রথম পুরস্কারটা আর
এবার কে আটকায়? জানি না কেন কোনদিন ভাবিনি, দ্বিতীয় তৃতীয় পুরস্কারও পেতে পারি। নাহ্, সবসময়
প্রথম, প্রথম, প্রথম। মেমরী দৌড়ে আমি
তো গিয়ে কাগজে যা যা লেখা আছে তা একবার দেখে আর একটু গিয়ে সব মেমরী থেকে লিখে
ফেললাম। কিন্তু তারপর দৌড়াতে হ’বে না? লাস্ট!
সাইকেল আমি বন্ধুদের
থেকে আগেই শিখেছিলাম। কিন্তু আমার সাইকেল তো প্রাতঃভ্রমণ কিংবা সান্ধ্যভ্রমণের
স্পীডে। সেবার স্কুলের স্পোর্টসে সাইকেল রেস যোগ হ’ল। আমাকে আর কে পায়। জীবনের স্বপ্ন
সফল হ’বে। স্পোর্টসের দিনে শুধু দাবা নয়, অন্য আর কোন একটা আসল ইভেন্টে পুরস্কার পাব। মেয়েদের সাইকেল রেসে মাত্র
চারজন। সকলে আমার পরে সাইকেল চালাতে শিখেছে, মেডেল আমার
গলায় ঝুলবেই ঝুলবে। আমি থার্ডও হ’তে পারলাম না। হ’লাম ফোর্থ!
কিন্তু শিকাগো
এয়ারপোর্টে টংসা সিম্বা পৌঁছাল কিনা দেখতে আমি দৌড়ে প্রথম হয়েছিলাম। শুনেছি
শিকাগো এয়ারপোর্টে নাকি সারাদিন রাত ধরে প্রতি পয়তাল্লিশ সেকেন্ডে একটা প্লেন
ওঠানামা ক’রে।
প্রতিদিন গড়পড়তা ২,৪০৯ প্লেন। আর তা থেকে পিলপিল ক’রে পিঁপড়ার মত মানুষ।
টংসা সিম্বা বিশেষতঃ
টংসা ওর দৃষ্টিসীমার পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে আমরা ছাড়া অন্য অচেনা কাউকে দেখলে ভৌ ভৌ
ক’রে
ছোটখাট বাড়ি তো নয় স্কাই স্ক্র্যাপার মাথায় ক’রে। আর অন্য
কোন কুকুর দেখলে তো কথাই নেই।
চারপাশে বম্ব স্নিফিং
ডগ্, ড্রাগ
স্নিফিং ডগ্, ফ্রুট-ভেজিটেবল-প্ল্যান্ট স্নিফিং ডগ্ ঘুরে
বেড়াচ্ছে। শুধু টংসা, সিম্বা কেন, আমরাও
কোনদিন আমেরিকা আসিনি। দৌড়ে ছুটে গিয়ে দেখি ওরা প্লেন থেকে নেমেছে। কোন ভৌ ভৌ
নেই। ওদের ছোট কেনেলের ভিতর বসে ভয়ে থরথর ক’রে কাঁপছে,
কুঁইকুঁই ক’রে কাঁদছে। তবু তার ভিতরই আমাদের
দেখে ওদের লেজ নড়ছে। আর ‘তোমরা তবে এলে? আমাদের ফেলে চ’লে যাও নি?’
২রা আগস্ট, ২০১৪
ওদের নিয়ে চেক আপ করাতে
এয়ারপোর্টের বুথে যেতে হ’ল। পছন্দসই কিছু না পেলেই আমেরিকা থেকে বিদায়। পৃথিবীর সব
প্রার্থনার ভাষায় গুনগুন করে ফেললাম। নাহ্, ফেরত যেতে হ’বে না। সব ঠিক আছে।
এবার রওয়ানা দিলাম
ম্যাডিসনের পথে। শিকাগো থেকে ম্যাডিসন প্লেনে ক’রে গেলেই হয়ত ভালো হ’ত। কিন্তু টংসা, সিম্বাকে নিয়ে আবার প্লেনের ধকল?
আমার ননদ ওদের জন্য মুরগীর মাংস আর ভাত রেঁধে এনেছিল। তাই খাইয়ে
ওদের গাড়িতে ক’রেই চলা শুরু হ’ল।
শিকাগো বরফে শাদা।
টিউলিপ ফুটে নেই। ফেব্রুয়ারি মাসে এদিকে সবচেয়ে বেশি বরফ পড়ে। ঠান্ডা কিছুটা
কমে যদিও। বহু বছর থাকবার পর এখানে এখন যখন আমাদের লম্বা শীতকালের পর তাপমাত্রা
জিরো ডিগ্রী ফারেনহাইট (মাইনাস সতেরো পয়েন্ট সাত সাত সাত সেলসিয়াস) হয়, আমরা ভাবি এই তো গরমকাল
তো প্রায় এসে গেল। আর আমার ছেলেমেয়ে হৈ, তাথৈ? ছেলেবেলায় পুরো শীতকাল প্রায় ঘরের ভিতর বন্দি থেকে চল্লিশ ডিগ্রী
ফারেনহাইট(চার পয়েন্ট চার চার চার সেলসিয়াস) তাপমাত্রা হ’লেই
ওয়াটার হোস বের ক’রে মাঠে ওয়াটার ফাইট শুরু ক’রে দিত।
কিন্তু তখনও আমরা
ফ্রিজের ভিতর ছাড়া বরফ দেখিনি। আর টংসা, সিম্বা? দু’ পা ত্রিভুজের মত ক’রে দাঁড়িয়ে থাকল বরফের উপর। এক
ইঞ্চি নড়ছে না। সিম্বার প্রপিতামহ জার্মান ছিল। রক্তের ভিতর কিছুটা হয়ত বরফের
ছিটেফোঁটা আছে। ও শেষমেষ দু’ পা এগিয়ে গেল। তাই দেখে টংসা।
দেশে থাকতে এত স্পীডে
কোন গাড়িতে ক’রে কোথাও যাইনি। দেশে গাড়ি মানেই জানালার পাশে কে বসবে তাই
নিয়ে মল্লযুদ্ধ। তারপর জানালার কাচ নামিয়ে বাতাসে উড়ে চলা। কুকুরদেরও বাতাসে
প্রায় চোখ বন্ধ ক’রে, ঝোলা কান
দুলিয়ে, গাড়িতে কাচ নামিয়ে চলার দৃশ্য আমার মাথার ভিতর
একটা ভীষণ প্রিয় ছবি। এখানে ইন্টারস্টেটের উপর দিয়ে তা হ’ল
না।
ম্যাডিসনে তো পৌঁছালাম।
হোটেলের ব্যবস্থা লালের অফিস থেকেই ক’রে রেখেছিল। সব হোটেলে কুকুর নিয়ে ওঠা যায়
না। চমত্কার ব্যবস্থা। একটা লিভিং রুম, কিচেন আর বেডরুম।
টংসা, সিম্বাকে নিয়ে কিছুটা হাত পা ছড়িয়ে থাকা যাবে।
রান্নাঘরে ওদের জন্য একটু মুরগীর ঝোল, ভাত রাঁধা যাবে।
মায়ের আদর।
৫ই আগস্ট, ২০১৪
এসে তো পড়লাম। কিন্তু
গতিবিধি, মতিগতি বুঝতে সময় লাগবে না? আর প্রকৃতি? সে বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ
যত কম ক’রা যায় ততই ভালো। নাকের জল নাকে থাকবে। চোখের জল
চোখে।
হোটেলের জানালা থেকে
যতদূর দেখা যায়, সব শাদা। এত শাদা দেখলে
মন খারাপ হ’য়ে যায়। যত মন খারাপ হ’য় তত টংসা, সিম্বাকে আরো চাপ্পু ক’রে জড়িয়ে ধরি। সিম্বা শাদা হ’লেও ওর শরীরটা গরম। বরফ
ঠান্ডা তো নয়।
হোটেলের ঘরের
টেম্পারেচার নব্বই ডিগ্রী ফারেনহাইট ক’রে মনে হ’য়, ‘যাক, এখনও তাহলে দেশেই আছি।’ ধীরে ধীরে শিখে ফেললাম বাজার করতে হ’লে ওয়াল-মার্টে যেতে হয়। ফ্যান্সি মেট ক্যাফে বা হাইভি তখনও শিখি নি। উইলি
স্ট্রীট কোওপ-এর অরগানিক কায়দাও নয়। আর লবণ? ক্ষমতার বাইরে গোরমে
হিমালয়ান পিঙ্ক সল্ট, হ্যান্ড হারভেস্টেডেড
ফিনিশিং সল্ট, কেলটিক কায়দায় তৈরী ফ্রেঞ্চ সল্ট। নামও
জানিনা ভালো ক’রে তাদের। সুতরাং, ব্যবহার করতে শুরু করলাম আইয়োডাইজড্ ‘মরটন সল্ট’। ‘হোয়েন ইট রেইনস্ ইট পোরস্।’
লালের অফিস থেকে একটা
লাল রঙের রেন্টাল কার দিয়েছিল। আসবার আগে তড়িঘড়ি সল্টলেকের ড্রাইভিং স্কুল থেকে
সার্টিফিকেট যোগাড় করা হ’য়েছিল গাড়ি চালানোর।
সে সার্টিফিকেট বটে, কিন্তু তার মানেই
প্রমাণপত্র নয় যে গাড়ি স্টার্ট আর স্টপ ক’রা ছাড়া চালাতেও জানি।
আর গাড়িতে গ্যাস(দেশে থাকতে ‘ইহাকে’ পেট্রল ভ’রা বলতাম)কিভাবে ভরে?
‘স্লেফ সার্ভিস কার ওয়াস’-এর দেশ এই আমেরিকা। নিজের মাথায় নাকি নিজেকেই তেল চাপাতে হ’বে। পা টিপে দেওয়ার লোক নেই। ‘সেদিন হয়েছে বাসি
যেদিন’ আমি বিছানায় ব’সে থাকব আর হাঁক দিয়ে লক্ষ্মীকে ডাকব। পাশের ঘর থেকে পড়িমড়ি লক্ষ্মী এসে
ফ্যানটা ফুলস্পীডে চালিয়ে দেবে। আমার গায়ে গরমের দুপুরে একটা খুব হাল্কা কাঁথা
দিয়ে আমারই মাথার কাছে রাখা জলের জগ থেকে এক গ্লাস জল ঢেলে দেবে। এর আমি ‘সমাজবাদ বাবুয়া ধীরে ধীরে আইই’ গানটা শুনতে থাকব।
দিন তিনেক আমরা গাড়ি
নিয়ে গ্যাস স্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা ক’রে একে দেখি, তাকে দেখি। কায়দাটা কি? একদিন এ্যালজেবরা যখন
শিখতে পেরেছি, পাটিগণিতটাও নিশ্চয়ই শিখতে পারব। লোককে
দেখে দেখে অবশেষে গাড়িতে তেল ভরা শেখা হ’ল। জীবনে নানা
পরীক্ষায় নানা মেডেল পেয়েছি। কিন্তু এত তৃপ্তি কোনদিন পাইনি। বাড়িতে গিন্নী, কর্তা দুইজন আর কেয়ারটেকার ছয়জনের দিন শেষ। মালি, রাঁধুনি, ঠিকে ঝি, ড্রাইভার, রাত দিন থাকবার বুয়া
আরো কে কে সব এবং কারা।
বিয়ে ক’রে যেমন কুকুর কিনবার স্বাধীনতা পেয়েছিলাম, আমেরিকা এসে তেমন নিজের কাজ নিজে ক’রে মানুষ হওয়ার
স্বাধীনতা পেয়ে গেলাম। এখানে আলোর সুইচ উপরেই অন হোক আর নীচেই অন হোক তা শিখে
ঘরের আলোটা নিজেকেই জ্বালাতে হ’বে।
দেশে থাকতে দেয়ালে
একটা পেরেক পুঁতিনি। আর সেদিন অফিস মীটিং-এ দেখি টিমের এক মেয়ে বেশ দেরি ক’রে এল। পাঁচ মিনিটের বেশি দেরি ক’রে কেউ যেখানে কখনো আসে
না, সেখানে হ’লটা কি? মেয়েটি এসে কত্ত যে সরি বলল। কাল রাতের
ঝড়ে বিরাট এক ওক গাছ পুরোটা ভেঙ্গে বাড়ির সামনে পড়েছে। ও একা থাকে। সে গাছ নিজে
নিজে কেটে গাড়ি বের ক’রে অফিস আসতে তাই একটু
দেরি হ’য়ে গেল।
ন্যাকামো ক’রে ওর পায়ের ধূলা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে লাভ ছিল না। চেইন স চালিয়ে
এসেছে ব’লে নকশা ক’রা জুতা আর নকশা ক’রা মোজা পড়তে ও একেবারেই ভুলে যায়নি। আমার এদিকে মাথা ভর্তি শুধু জবজবে তেল।
আর এতদিন তা এ সে বিলি কেটে গেছে।
৭ই আগস্ট, ২০১৪
বাইরে তখন উইস্কনসিনের
হাঁটুসমান বরফ। আমরা হোটেল ঘরের তাপমাত্রা একবার বাড়াই, দেশের গরমকাল ক’রে ফেলি, ঘেমে নেয়ে আবার কমাই। টংসা সিম্বার ভাউ ভাউ-ও একবার কমে, একবার বাড়ে। আমরা দোতালার ঘরে ছিলাম। কেউ একটা নিশ্চয়ই
কমপ্লেন করেছে। আমাদের নামিয়ে দিল... একতলায় কোণের এক ঘরে। দুষ্টুমি ক’রে বাচ্চাদের কর্ণারে দাঁড় করানোর মত এবার কর্ণারের ঘরে যাও। ঘরে বাজারের
ভিতর আছে আলু, পিঁয়াজ, ডিম, ডাল, চাল, কিছু সব্জি, চিকেন, হলুদ। কিন্তু দেশ থেকে মাত্র এসেছি। পাঁচফোড়ন, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, কাঁচা মরিচ, ধনে, জিরা, এলাচ, দারচিনি ছাড়া কিভাবে কী রাঁধব ভেবে না পেয়ে আমি ডিমের চপ
বানিয়ে ফেললাম। সকলের কী হাসি। আমার নাকি ঘরকন্না করবার মেজর ইনগ্রিডিয়েন্টগুলো
ছিল।
দিন পনেরো কাটানোর পর
বোঝা গেল টংসা সিম্বার মত এমন পিএইচডিপ্রাপ্ত কুকুর নিয়ে হোটেলে বেশিদিন থাকাটা
ঠিক হবে না। ঘর খোঁজা শুরু হ’ল।
আমাদের বেশির ভাগ
বন্ধুরা প্রথম এসে এপার্টমেন্টে উঠেছে। আমাদের কপালে তা হ’ল না। ওদের একটু জায়গা চাই। হোলবোর্ন ভিলেজে এক টাউনহাউজ খুঁজে পাওয়া গেল।
এ পৃথিবীতে আমাদের
দেখেছে, কিন্তু টংসা সিম্বাকে চেনে না, এমন মানুষের সংখ্যা কম। আর ওদের গলার গলাসাধা শোনেনি এমন
মানুষ খুঁজেই পাওয়া যাবেনা।
বছরখানেক হোলবোর্ন
ভিলেজে কাটানোর পর লাল বলল, ‘আসলে এভাবে ঠিক
মানসম্মান থাকছে না। আশেপাশের সব কুকুরের মুখে কুলুপ আঁটা। আর আমাদের গুলো?’ আমি ওদের পক্ষ নিয়ে বলে যেতে থাকলাম, ‘ওরা তো আসলে আমাদের পাহারা দিচ্ছে!’ সত্যি সত্যি পাড়া
পড়শি, দোকানদার অনেকেই আমাদের বলেছে, ‘খুব ভালো গার্ড ডগ তো।’ আমেরিকান বিনয়টা তখনও
আমি শিখে উঠি নি। কোন কথার আসল মানেটা যে কি তা তখনো রহস্য। শুধু মনে মনে উত্তর
দিয়েছি, ‘হ্যাঁ, আমরা কোহিনূর!’
লাল এদিকে খবরের কাগজ
দেখে যাচ্ছে। অবশেষে খুঁজে পেল এক ফার্ম হাউজ। ওনারের তিনটা বাড়ি সেখানে। ছয়শ’ একর জমি। আমাদের বাড়ির সাথে দুইশ’ একর। দেড়শ বছরের পুরানো সেই বাড়ি ভাড়া দেবে।
পিছনে বাড়ির গা ঘেঁষে
পাহাড়। লাল বলে চলেছে,‘ভোরবেলা ব্যাগপ্যাক
নিয়ে পাহাড়ে উঠে ব্রেকফাস্ট খাওয়া যাবে টংসা সিম্বাকে সাথে নিয়ে।’ বাড়ির সামনে নদী, প্রেইরী, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পঁচিশ, তিরিশটা হরিণ বের হয়। পরের সবচেয়ে কাছে যে বাড়ি তা গাড়ি
ক’রে যেতে হ’য়। আমাদের ম্যারাথনের
দৌড় ততটুকুই। আসলে এক মাইলের কিছু বেশি দূর হবে। এমন আশে পাশে কোন মানুষ ছাড়া এর
আগে কখনো কোথাও থাকি নি।
বাড়ির সাথে প্রায়
বিশটা মত আউট বিল্ডিং। মুরগীর ঘর, ভেড়ার ঘর, ঘোড়ার ঘর, গরুর ঘর, পিগদের ঘর, স্মোক হাউজ, তামাক পাতা শুকানোর ঘর...মসৃণ বাদামী পাথরের তৈরী ফসল
রাখবার জন্য সাইলো। সাইলোর নীচে আর একটা অনেক বড় ঘর। সারি সারি কাঠের খাট পাতা
আছে। বাঙ্ক বেডের মত। ফলে আমাদের বাড়িওয়ালা এই ঘর ফলে হরিণ শিকারীদের ভাড়া দিত।
রক্ত আর মৃত হরিণ চারদিকে। আমি ঘর থেকে বের হতাম না।
আমরা একটা ঘর গ্যারেজ
মত ক’রে গাড়ি রাখতাম। অন্য আর সব ঘর খালি পড়ে আছে।
যতদূর চোখ যায় ব্ল্যাক
সুজান ফুটে আছে। সোনালি-হলুদ ফুল, মাঝখানে কালো বোতামের
মত। ছেলেবেলায় লরা মেরীর বই-এ পড়েছিলাম, উইস্কনসিনের ধবধবে শাদা
শীতকাল পার ক’রে একসময় ব্ল্যাক সুজান ফোটে। আমি তো এই ফুল কখনো দেখি নি। আর এখন এমন মাঠের পর মাঠ
প্রেইরী ফ্লাওয়ার ফুটে থাকা?
পুরানো একটা প্রায়
আকাশছোঁয়া উইন্ডমিল। উইন্ডমিলের পাখাগুলোয় জং ধরেছে। সময়ের। উইন্ডমিলের সামনে আগে
যারা ছিল তাদের লাগানো ম্যামথ সানফ্লাওয়ার। সূর্য ফুটে আছে। নানা পাখি সূর্যমুখী
ফুলের বিচি খুঁটে খাচ্ছে। গ্লোডফিঞ্চ চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা থিসল।
আমি স্বপ্নের ভিতর
হাঁটতে থাকলাম।
বিকাল হলেই টংসা
সিম্বা-কে নিয়ে ছোট নদীটায় যাই। আমি জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। আবারো লরা মেরীর
প্লাম ক্রীকের কথা মনে হ’য়। শার্লট পুতুল। আর
টংসা সিম্বা কোমর সমান জলে জলের পোকাকেই ভৌ ভৌ দেয়। আমার বুনো কুকুরদের একটা বুনো
জীবন দিতে পেরে নিজেকে খুব বেশি ভালো মনে হ’য়।
আসলে কোন মানুষকে দেখে
ভৌ ভৌ করবে এমন কেউ আমাদের ত্রিসীমানায় নেই। আছে শুধু কাঠবিড়ালী, হরিণ, টার্কি, ময়ূরের মত দেখতে ফেজেন্ট, বল্ড ঈগল, স্যান্ডহিল ক্রেন। একটা আউট বিল্ডিং-এ
দেখি মিষ্টি মত দেখতে উডচাক বাসা বেঁধেছে। সেই আউট বিল্ডিং-এ সেই শুধু থাকে।
কয়েকটা ছানা হয়েছে। আর আছে কে? সন্ধ্যা হ’তেই আমার বার্ড ফীডারের কাছে গুটি গুটি এগিয়ে এল ধূসর রঙের প্রাণী। মুখে কালো
মত। যেন মাস্ক পড়েছে। আমি তো আনন্দে আত্মহারা। কি অসাধারণ দেখতে! এরা কারা? পরের দিন থেকেই ওদের খাবার দিতে শুরু করলাম। সবাই ধমকে দিল, ‘রেকুন-দের একদম খাবার দেবে না। ওদের র্যাবিস হয়। কামড়ে দেবে।’ মানুষ আমায় কামড়ে না দিয়েও এ জীবনে যত কামড়েছে, তার কথা মনে ক’রে রেকুন-দের খাবার
দেওয়া আমি কিছুতেই বন্ধ করতে পারলাম না। বাড়ির আশে পাশে অনেক স্কাঙ্ক-ও ছিল।
যারা ওদের চেনে, তাদের জন্য বলি আমি
ওদের কিছু খেতে দিই নি! ওরাও ওদের বেলীফুলের সৌগন্ধ করুণা ক’রে কোনদিন আমার ফুলদানিতে রেখে যায় নি।
এই বাড়িতে না আসলে
কোনদিন অন্ধকার কাকে বলে, আর আলো কাকে বলে তা
বুঝতাম না। চারপাশে কোন ইলেক্ট্রিক লাইট নেই এক আমাদের বাড়ি ছাড়া। কালো রঙ যে এত
রঙের হয়! এদিকে পৃথিবী আর পাহাড় ছেয়ে ফেলা পূর্ণিমার চাঁদ। আকাশে আমার
অস্তিত্বের প্রতিটি কণার মত অগুনতি তারা। মাঠভরা রুপালি জোনাকি। পুরো অন্ধকার
জুড়ে শুধু আলো আর আলো।
অনেকটা টংসা সিম্বার
জন্যই এই স্বর্গে আমাদের আসা। লাল ছোঁওয়া শাদা বুক গ্রসবীক, দেশের শালিক পাখির মত দেখতে আর নীল নীল ডিম পাড়া রবিনপাখি, লাল কার্ডিনাল, কালো ছিট ছিট ডাউনি উডপেকার, নিঝুম দুপুরে মন খারাপ করা একটানা সুরে গান গাওয়া ঘুঘুপাখি, ছটফটে চিকাডি, পাখায় আকাশের নীল আর
বুকে সূর্যাস্তের হলুদ নিয়ে উড়ে যাওয়া ব্লুবার্ডদের সাথে সাথে বসন্তে আমরাও
নতুন বাসা বেঁধে ফেললাম। আমাদের বাসা রুপালি বার্চ গাছের উপরে।
১১ই আগস্ট, ২০১৪
একদিন দুপুরবেলা।
বার্নমত যে লাল রঙা ঘরগুলো তার এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করছি। হঠাত্ দেখি টংসা
সিম্বা নেই। ‘লাল,
তোর কাছে? তুই দেখেছিস্?’ অত খোলা প্রান্তর হ’লেও আমি কোনদিন ওদের এক ঘরের
ভিতর বাদে লীশ ছাড়া ছেড়ে দিতে পারিনি। বড় ভয়। এই বুঝি হারিয়ে যাবে। কিন্তু
কোন ফাঁকে কোথায় উধাও। আত্ঙ্কে দু’জন দৌড়, দৌড়। এই ছয়শ একর জমির ভিতর কোথায় ওদের খুঁজে পাব? আমি বলে চলেছি, ‘এক্ষুণি পুলিশে খবর দে। ওরা এসে
হেলিকপ্টারে ক’রে আমার টংসা, সিম্বাকে
খুঁজে বের করবে।’ আমি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেছিলাম, এমনটা হ’তে পারে। আমাদের দেশে নিখোঁজ মানুষ খুঁজে
পাওয়া যায় না, খুঁজে পাওয়া যায় না হারানো সম্পত্তি কিংবা
সম্পদ। কিন্তু এদেশে নিশ্চয় হেলিকপ্টার দিয়ে হারানো কুকুর খুঁজে পাওয়া যাবে।
টংসা সিম্বাকে হারিয়ে ফেলবার দুঃস্বপ্ন আমি প্রায় পুরোটা জীবন ধরে দেখে গেছি।
কতবার মাঝরাতে ধড়ফড় ক’রে যে উঠেছি! কারা যেন ওদের নিয়ে
গেছে। ওরা বরফে নিজেদের পায়ের ছাপ আর না খুঁজে পেয়ে বাড়ি ফিরতে পারেনি। এখনও
মনে পড়ে কোলকাতার লেকটাউনে থাকতে সেই শাদা কুকুরটার কথা। সিম্বার মত দেখতে একটা
শাদা কুকুর রাস্তা দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। শাদা লোম কাদা মাখা। কেমন পাগলের মত। পিছনে
রাস্তার নেড়িরা ধেয়ে চলেছে। কে একটা বলল বাড়ির পোষা কুকুর অসুস্থ হ’য়ে পড়লে অনেকে নাকি এমন ছেড়ে দেয়। অনেক সময় কুকুর হারিয়েও যায়, আর পথ চিনে বাড়ি ফিরতে
পারে না। পরে স্টউটনে যখন আমাদের গ্রামের বাড়িটায় ছিলাম, কত
কুকুর যে পথ হারিয়ে আমাদের বাড়ি এসেছিল। গ্রামের বাড়ি ব’লে
অনেকে আবার কুকুর ছেড়েও দিয়ে যেত। যেন ওদের দায়িত্ব শেষ। এবার গ্রামের লোকজন ওর
কুকুর সামলে রাখবে। বুকটা আমার ফেটে যেত। ওদের খাবার খেতে দিতাম, জল। তারপর নো কিল হিউম্যান সোসাইটি-তে ফোন ক’রে ওদের
ডাকাতাম। নয়ত নিজে গিয়েও কুকুর জমা ক’রে দিয়ে আসতাম। কত
কুকুর, বিড়াল যে ওখানে লোকে রেখে গেছে। চোখ মেলে দেখা যায়
না। ছোট ছোট খাঁচায় ওরা আছে। একদিন কারো কত প্রিয় ছিল। নানা কারণে আর রাখা সম্ভব
হয় নি। হিউম্যান সোসাইটির ভল্যান্টিয়াররা কী আপ্রাণ চেষ্টাই না করছে ওদের একটু
ভালো করতে।
আমারও প্রার্থনা শুরু হ’ত। ‘কেউ
যেন ওদের এডপ্ট ক’রে নেয়। ওরা যেন আবার একটা ঘর পায়। লাল
বল নিয়ে বাড়ির ছোট বাচ্চাদের সাথে সবুজ মাঠময় দৌড়াতে পারে। সেকেন্ড চান্স!’
ছুটছি আর ছুটছি। আবার ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার জন্য। গিয়ে
দেখি বেশ কয়েকটা মাঠ পরে একটা গাছে টংসা প্রায় অর্ধেক চড়ে বসেছে। সিম্বা দু’পা উচুঁ ক’রে গাছের বাকল নখে খামচে ধরে আর দু’পা মাটিতে রেখে
প্রাণের সুখে ভৌ ভৌ দিয়ে চলেছে। গাছের মাথায় এক কাঠবিড়ালি।
১২ই আগস্ট, ২০১৪
নদীর উপর সাঁকো দিয়ে
চলতে গিয়ে জীবনে এমন হয়ই যে নদীর মাঝপথে এসে দেখা যায় বাকি সাঁকোটুকু ভাঙ্গা।
এবার নদীতে পড়ে যাব। টংসা সিম্বাকে নিয়ে আমার পরের গল্পটুকু তেমন। লালের সবসময়ই
এজমা। তবে এবার ডাক্তারের কাছ থেকে এসে দেখি সে গম্ভীর হ’য়ে ঘুরছে। দুইদিন পর বলল ওর নাকি লাং পাওয়ার ৫০% হ’য়ে গেছে। কুকুরে অসম্ভব এলার্জি। ডাক্তার বলেছে কিছুতেই বাড়িতে কুকুর রাখা
যাবে না। থ্যাঙ্কসগিভিং-এর আগের দিন ছিল সেটা।
খোঁজ পেলাম এক দ্বীপের। ‘ফ্রি ফরএভার ডগ্ আইল্যান্ড।’ সেখানে নাকি কুকুরদের
ছেড়ে দেওয়া যায়। হাজার হাজার কুকুর চারপাশে। জলের মাছ ধরে খায়। হাজার হাজার
খরগোশ চারপাশে। বছর দুই আগে নাকি দশ হাজার খরগোশ ছেড়েছিল দ্বীপে। খরগোশ বলে কথা!
তার সংখ্যা বেড়ে এখন খাবারের অভাব নেই। সমুদ্রের জলের পাশে শেষ সূর্যাস্তের আলো
দেখে কবি হ’তে কোন কুকুরেরই কোন অসুবিধা হ’বে না। আমি নিজের ঘরের পাশে কোনদিন ওদের খোলা ছাড়তে পারি নি। আজ দ্বীপে ছেড়ে
দেব? শিকার ক’রে খাবে? মুক্ত, স্বাধীন?
তবে কি করব? নো কিল হিউম্যান সোসাইটিতে দিয়ে আসব? উডম্যান গ্রোসারি শপের দেয়াল জুড়ে ছবি চিটিয়ে দেব? খোঁজ নেব অন্য কেউ এডপ্ট করতে চায় কিনা? কিন্তু ওরা যে আমাদের কুকুর, শুধুমাত্র আমাদের। অন্য কেউ এসে মাথা আঁচড়ে যাবে আর ওরা
লেজ নাড়বে, এমন তো হবার নয়। ওরা শুধু আমার পায়ের
কাছে, আমার মাথার কাছে ঘুমাবে। আমার সোনার কাঠি, আমার রুপার কাঠি। এই গল্পের পুরোটুকু একসাথে বলবার মত প্রাণের শক্তি আমার নেই। আর একদিন লিখব।
১৩ই আগস্ট, ২০১৪
টংসা সিম্বাকে নিয়ে
আবার ফার্ম হাউজের রুপালি বার্চবনের গল্পে ফিরে আসি। মানুষের জীবনে রুপালি আর
সোণালি রঙ সবসময়ই রক্তের লাল ঢেকে দেয়।
টংসা সিম্বা বাংলাদেশের
পুলিশ বাহিনীর মত। কারণে অকারণে একে তাকে ধাওয়া দেয়। সুযোগ পেলেই হরিণ, রেকুন, এমন কি সৌগন্ধের ভয় না
ক’রে স্কাঙ্ক। সব সময় ওদের নিয়ে ‘গেল গেল ধর ধর’। আসলে ওরা কাছে থাকলে শুধু খিলখিল হাসি।
মৃত্যু নেই, কষ্ট নেই, কোন রকম দুঃখ নেই। কেবল ‘দেখ দেখ এবার কী ক’রে ফেলল’।
এদিকে হৈ-এর জন্ম হ’বে। এতদিন কুকুরছানা নিয়ে হট্টগোল ক’রে এবার মানুষের ছানা।
আমার ‘হিউম্যান পাপি আর ক্যানাইন বেবি’। কিন্তু আমাদের হৈ তো
ধ্যানে বসেছে। কোন রকম নড়াচড়া নেই। আমাদের সক্ প্রেইরী থেকে প্রত্যেক রাতে এক
ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে প্রায় ষাট মাইল দূরের ম্যাডিসনে নিয়ে যায় লাল । বড়
হসপিটাল ওখানে। ট্রিয়াজে মনিটর লাগিয়ে শুয়ে থাকি ঘন্টাখানেক। নাহ্, হৈ নড়বে না বলেই পণ করেছে। সকলের মুখ থমথম।
মানুষ কত কিছু কেনে।
আমরা কিছুই কিনলাম না। ক্রিব নয়, কোন তুলতুলে জামা নয়, নরম মোজা নয়, র্যাটল বা র্যাটল
স্নেক কিছুই না। নাম ঠিক করা হ’ল না। পদ্মরাগ মণি
ছাড়া মণি রাখবার সোনার থালা দিয়ে কি হবে?
ডাক্তাররা আমাকে
ক্যাফিনেটেড কোক দেয়, কফি দেয়, চা দেয়। জোরে জোরে মিউজিক বাজায়। যদি কোনভাবে বেবীর একটু
মুভমেন্ট হ’য়। কিসের কি? সবাই আরো গম্ভীর হ’য়ে যায়। আমি শুধু হেসে বলি, ‘আমার বেবি টংসা সিম্বার ভৌ ভৌ শুনে অভ্যস্ত। ঢাক ঢোলের শব্দ ওর কি করবে? নিশ্চিন্ত মনে আছে। ওকে থাকতে দাও।’
‘হাই রিস্ক প্রেগনেন্সি’ বলে ঘোষণা দিল ডাক্তার। দেশে থাকলে চিকেন সুপ বানিয়ে মুখের কাছে ধরে নানা রকম আহা উঁহু করবার লোক পাওয়া যেত। মা, দিদা, দাদু, মামা, মাসী, ডজন খানেক মাসতুত
মামাতো ভাইবোন, পাড়া পড়শি। শুধু ‘এ পরবাসে’ কেউ ‘নাই’। লাল অফিস যাওয়ার আগে
মাথার কাছে চিরিও, কিছু শুকনো খাবার আর ফল
রেখে যায়। আমি অফিস টফিস বাদ
দিয়ে মাসের পর মাস বিছানায় লেপ্টে থাকি। টংসা সিম্বা টহল দিয়ে যায়। ‘আজ ভালো আছো তো? একটু চেটে দেব কি? তবে মন ভালো হ’বে? তুমি যে দেখছি হাঁটতে ভুলে গেলে! বল নিয়ে আসব? ছোঁড়াছুড়ি খেলবে?’ আমি পাশ ফিরে শুই।
নাহ্, এভাবে তো আর চলে না। গ্রামে আর থাকা নয়। আমরা যে বাড়িটাতে
থাকতাম তা দেড়শ বছরের পুরানো হলেও তা রিমডেল করা হয়েছিল। সব ঘরের মেঝেতে সোণালি পাইন কাঠ বসানো হয়েছে। উইস্কনসিনের লম্বা শীতকালে যখন সূর্য উধাও
হ’য়ে যায়, পাইন কাঠের মেঝে মন
ভালো ক’রে দেয়। গরম দেশের মানুষ আমরা। হলুদ সূর্যমুখি ছাড়া বাঁচি না। রান্নাঘরের কাউন্টার টপটায় আগেকার দিনের কালো স্লেট
পাথরটুকু রেখে দিয়েছে। সব জানালায়
বাড়িওয়ালারই লাগানো মার্কিন কাপড়ের মত কাপড়ে পর্দা। সবুজ ডিজাইন ক’রা বর্ডার। পর্দাগুলো ক্যাফে স্টাইলের। জানালার অর্ধেকটা জুড়ে। যদিও কোন জানালা দিয়ে রেকুনরা ছাড়া আর
কেউ ঘরের ভিতর উঁকি দেওয়ার নেই, তবু বলব বড় মানিয়েছে
এ বাড়িতে এই ক্যাফে স্টাইল।
এই দেড়শ বছরের পুরানো
বাড়ির পাশেই প্রায় গা ঘেঁষে আর একটা বাড়ি আছে। তা আর রিমডেলিং করবার যোগ্য নয়। পুরো বাড়ি ভাঙ্গা। কিন্তু সে বাড়িতেও দুধ শাদা ইস্ত্রি করা আইলেটের ডিজাইন ক’রা পর্দা। কবেকার, কত বয়স কে জানে, তবু টান টান ঝুলে আছে
কোন আপত্তি না দেখিয়ে। এই একদম ভাঙ্গা বাড়িটায় মাঝে মাঝেই আমি যেতাম। নিজেকে ‘ফেমাস ফাইভের’ কেউ ব’লে মনে হ’ত। কিংবা ইন্ডিয়ানা জোনস্। এ ভাঙ্গা ঘরে উকিঝুঁকি, ও ভাঙ্গা ঘরে উকিঝুঁকি। মাটি ফুঁড়ে গোখরো সাপ বের হ’বে নাকি গুপ্তধন? এ তল্লাটে যদিও
নির্ভেজাল গার্ডেন স্নেক ছাড়া কোন সাপ নেই। তবু বর্শা না থাকলেই যে বর্শা ঘোরাতে হ’বে না এমন তো কেউ বলেনি। আরও উত্তরে আছে র্যাটল স্নেক। অবশ্য আমি সে ঝুমঝুমি আজ পর্যন্ত শুনিনি।
পুরানো বাড়ির দোতালায়
এ্যাটিকে দেখি তিনটা লোহার বিছানা। এখানে ওদের ছেলেরা থাকত বুঝি? এ্যাটিকের ঘর সবসময় এত
অদ্ভুত লাগে আমার। ত্রিভুজের মত, ঘরে দাঁড়ালে ছাদ প্রায় মাথায় ঠেকে যায়।
আর নীচের তলায় বাবা মা? বাবা মা-র বিছানার মাথার কাছে
ছোট স্টুলে নীল আর বেগুনি ফুল তোলা সিরামিকের পিচার। জল খেত? মুখ ধুত? হাত? পাইওনিয়ার জীবন
দেখিয়েছে এমন সব সিনেমায় এই পিচার দেখেছি আমি।
হুড়মুড় ক’রে কবেকার নানা গল্প মনে পড়ে যায়। রোদটুপি পিঠের উপর ফেলা, যে মাঠের শেষ নেই, সে মাঠে বাচ্চা মেয়েরা দৌড়ে যাচ্ছে। ছেলেগুলো বাবার সাথে ঘোড়ার পায়ে হর্সশু পড়াচ্ছে।
বরফের ভিতর স্লেড-গাড়ি ক’রে কেউ বুঝি এল? ঘোড়াদের কালো চকচকে
চামড়া থেকে তেল গড়িয়ে পড়ছে। গরম গরম আপেল পাই।
কিন্তু এবার এই
ফার্মহাউজের অতীত এবং স্বপ্ন - সব ফেলে যেতে হ’বে। পুরানো, জং পড়া উইন্ড মিল...
১৪ই আগস্ট, ২০১৪
চার সুটকেস নিয়ে এ
পরবাসে এসেছিলাম। আমাদের পৃথিবীর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সব সেখানে। এখানে এসে
মাসের পর মাস মাটিতে চাদর পেতে শুয়েছি। ম্যাট্রেস কিনবার বারশ ডলার জমাতে পারিনি।
কিন্তু বাড়ি ঘর না সাজিয়ে বাঁচব কিভাবে? তা যে ভাত খাবার মতই জরুরী। তখন গ্যারেজ
সেল থেকে কত কী আবর্জনা যে কিনে এনে দেওয়ালে ঝুলিয়েছি। অথচ এখন? এ বাড়ির জিনিস অন্য বাড়িতে নিতে কি শেষমেষ আঠারো চাকার সেমাই ট্রাক
ডাকতে হ’বে? অতটা না হ’লেও ‘টু মেন এন্ড অ্যা ট্রাক’ এল।
আমি যে অকেজো। বিছানায় গড়াগড়ি। আমেরিকার প্রধান ছোঁয়াচে রোগ প্রয়োজন ও
অপ্রয়োজনের জিনিষ মেগা স্কেলে জমিয়ে ফেলা। আমরাও সে রোগে আক্রান্ত। তবে আমাদের
জমানো জিনিষ একটু আঁতেল গোছের। ট্রাকে বাক্স বাক্স বই উঠল। আমাদের জমানো জিনিষ
নান্দনিক। বাইরে বরফ ব’লে ঘরের ভিতর আমার প্রায় একশ’
ফুলগাছ, লেবুগাছ, পুঁইশাক।
নিজেই গ্রো লাইট বানিয়ে টাইমার দিয়ে তা চোদ্দ ঘন্টা জ্বালিয়ে গাছপালার সংসার
আমার। একটা কুল হোয়াইট ফ্লোরেসেন্ট লাইট আর একটা ওয়ার্ম হোয়াইট ফ্লোরেসেন্ট
লাইট দিয়ে ফুল স্পেকট্রাম লাইট হয়। যারা বাগান ক’রে তারা
সব সময়ই বড় বেশি ‘ফ্রুগাল’ হ’য়। একসেসারিস না কিনে পয়সা বাঁচিয়ে আর একটা বেলী ফুল গাছ কেনে।
ডিসেম্বর মাস। বাইরে
বরফ। পা টিপে টিপে লোকজনের হাত ধরে গাড়িতে উঠলাম। পা পিছলে আলুর দম হওয়া
অবাঞ্ছনীয়। ন্যাকামো করতে করতে আমি ভাবি তাও ভালো আমার হাতীর বাচ্চা হচ্ছে না। এই
কয়মাসেই জিভ বেড়িয়ে যাচ্ছে, আর হাতী হ’লে ছয়শ’ পয়তাল্লিশ দিন লাগত।
দেশে থাকলে এখন
পঞ্চাশটা উপদেশ পাওয়া যেত। ‘এ সময় খুব সাবধানে চলতে হ’য়। ভারী কলসি
তোলা যাবে না।’ এটা যাবে না আর সেটা যাবে না শুনেই জীবনের
অর্ধেক কেটে গেছে। আর এখন সব ক’রা যাবে শুনেই কাটছে বাকি
অর্ধেক। এখানে দেখেছি বাচ্চা হ’বার তিনদিন আগে আমার কলিগ
হাসতে হাসতে সুইমিং পুল এপার ওপার করছে। বাবাগো মাগো নেই। কিন্তু আমরা যে
ফুলদানিতে ফুটেছি, আমরা যে আলাদা।
হয় এপথ নয় সে পথ।
মাঝপথ কোথাও নেই।
খ্রীস্টমাসের আগের দিন
ফার্মহাউজ ছেড়ে শহরের বাড়ি এসে পৌঁছালাম। গ্রামে থাকতে চারপাশ ঘিরে মাঠের পর মাঠ
খ্রীস্টমাস ট্রী ছিল। আমাদের বাড়িওয়ালার খ্রীস্টমাস ট্রী ফার্ম। আকাশের তারা সেই
খ্রীস্টমাস ট্রীর মাথায়। আর চাঁদ। দিনেরবেলা শাদা বরফে রেড কার্ডিনাল সেই
ঝাউপাতায় বসে গান গায়। শাদার উপর লালের স্বর্গীয় সৌন্দর্য। গাছের ডালে বসা ব্লু
জে-এর নীল রঙ বিদেশি মেয়ের চোখের নীল-কে হার মানায়। কিন্তু গাছ বেয়ে রুপালি
জরির মালা নামছে না। নেই পপকর্নের গারল্যান্ড। ফারগাছের পাতায় পাতায় পাখিদের বসে
থাকা ছাড়া নেই অন্য আর কোন হেয়ারলুম অর্নামেন্ট। শহরে এসে খ্রীস্টমাসের সময়
চারদিকের লাল, নীল,
রুপালি, সোনালি ঝিলিমিলি দেখে আমরা তো একদম
আশ্চর্য হ’য়ে গেলাম। যেন বরফে ডুবে থাকা তাইগার জঙ্গল থেকে
চুক গেকের মস্কো শহরে এসে পড়েছি।
টংসা সিম্বা-ও চারপাশে
অনেক অনেক কুকুর দেখে ভীষণ রকম খুশি হ’ল। পা তুলে, লেজ নেড়ে,
কান ঝুলিয়ে, নাক লম্বা ক’রে অন্যান্য পাড়া পড়শি কুকুরের সাথে ভাবের আদান প্রদান শুরু করল।
আমাদের পাশেই এক দরদী
কাপল। এটাও টাউন হাউজ। আমরা একই দেয়াল শেয়ার করব। ওরা দেখি আমরা মুভ ক’রে খুব ক্লান্ত
হ’তে পারি ভেবে আর আমার পটকা মাছের মত গোল
গাপ্পা চেহারা দেখে ক্যাসারল নিয়ে এল। আমি এ দেশে এসেও ডাল ভাত আর সরষে দিয়ে
চচ্চড়ি রাঁধি। কোনদিন ক্যাসারল খাই নি। মানুষ যে কত ভালো হ’তে
পারে তা আর একবার প্রমাণিত হওয়ায় আমার চোখের কোণে জল এল।
খ্রীস্টমাসের পরের দিন
ভোরবেলা। সুন্দর সূর্য দেখে আমি আড়মোড়া ভাঙছি আর ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিং টি
খাচ্ছি। লাল বানিয়েছে।
রেন্টাল প্লেসের অফিস
থেকে ফোন এল। আমাদের কুকুর নাকি ভৌ ভৌ ক’রে পড়শিকে খ্রীস্টমাসের দিন রাতে একটুও
ঘুমাতে দেয়নি। আর রেন্টাল প্লেসের অফিসে ফোনটা করেছে আমাদের ক্যাসারল দিয়ে
যাওয়া প্রতিবেশি।
১৫ই আগস্ট, ২০১৪
আমার
সিম্বার ষোল বছর হয়েছে ঠিকই, কিন্তু
ছোট্ট পাপির মত। দৌড়াদৌড়ি ক’রে বল
নিয়ে ছুটে আসে। এদিকে আরথারাইটিস। সকাল বিকাল রিমাডল দেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারে
না। কিন্তু মাঠে ছেড়ে দিলেই বল নিয়ে খেলা। অফিস থেকে ফিরেছি। সিম্বা মুখে বল
নিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। খেলবে। দূরে ছুঁড়ে দেই। এক নিমেষে তা মুখে নিয়ে আবার
হাজির। নরম শাদা বিড়ালের মত দেখতে লাগছে আজকে ওকে।
বাগানে আমার বেগুনি রঙের রোজ অফ্ শ্যারন ফুটেছে। এদেশের
জবা। তার পাশে গাঢ় গোলাপি টল্ ফ্লক্স, লাল রঙের বী বাম। টুকটুকে লাল রঙ দেখে
হামিংবার্ড এসে মধু খেয়ে গেল বী বাম থেকে। এই ফুলের বেডে দাঁড়িয়ে
হঠাত্ আকাশ ফাটানো চীত্কার সিম্বার। কি হ’ল? এই তো বল খেলছিল। ভালো ক’রে হাঁটতেই পারছে না। কোলে তুলতে গেলে
কাঁদছে। ঠিক আছে। ওর গলায় লীশটা লাগিয়ে আস্তে আস্তে পথ দেখিয়ে বাড়িতে নিয়ে
গেলাম। অন্য সময় হ’লে লাফ
দিয়েই বিছানায় উঠে পড়ত। ওর বিছানাটা একটা ফুটন। তার অর্ধেক জুড়ে নানা রকম
স্টাফড টয়। একটা শাদা স্নোম্যানও আছে। বিছানায় বসে সিম্বা এ খেলনা চিবায়, সে খেলনা চিবায়। র হাইড চিবায়। নিজেকে
কুকুর মনে ক’রে।
কিন্তু আজ দেখি মাটিতে শুয়ে পড়েছে। কষ্ট হচ্ছে মনে হয়
বিছানায় উঠতে। মাটিতে কম্বল বিছিয়ে দিলাম। সেখানে শুয়ে কাঁদছে আমার সিম্বা।
সবসময় দেখেছি অসম্ভব সহ্যশক্তি ওর। যত কষ্টই হোক টু শব্দ ক’রে না। আজ কত কষ্ট হচ্ছে ওর? কেন এভাবে
কাঁদছে? লালকে
ফোন করলাম তাড়াতাড়ি অফিস থেকে আসবার জন্য।
ইমারজেন্সির জন্য ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে ম্যাডিসনে দু’টো এনিম্যাল হসপিটাল। ইস্ট সাইডের
হসপিটালটায় ছুটলাম সিম্বাকে নিয়ে। এখানেই নিয়ে এসেছিলাম টংসাকেও। সিম্বার
কান্নার শব্দটা একটু যেন কম মনে হচ্ছে। তার মানে কি ব্যথা কমে গেল? গাড়িতে হাত মুঠো ক’রে বসে আছি আমি। নখ নিজের হাতের তালুতে
ঢুকে যাচ্ছে প্রায়। সব সময় এমন। ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে...’
পৌঁছে গেছি হসপিটালে। সিম্বা প্রায় অজ্ঞানের মত। এত ব্যথায় যদি কামড়ে দেয়, যদি ভৌ ভৌ ক’রে...আমরা ওর মুখে মুখোশটা দিয়ে নিয়ে
এসেছিলাম। নার্স ওকে দেখে প্রথমেই মুখোশ খুলে নিল। বলল কামড়ানোর মত শক্তি ওর আর
নেই। ভৌ ভৌ তো নয়ই। জীবনে এই প্রথম নিশ্চিন্ত হওয়া গেল? সিম্বা
নতুন লোক দেখে আর ভৌ ভৌ করবে না?
ইতিমধ্যে এক ঘন্টা কেটে গেছে। ডাক্তার ওকে স্যালাইন দিতে
শুরু করেছে। সেই সাথে পেইন কিলার। রক্ত দিচ্ছে। ও নাকি আর ব্যথা পাচ্ছে না। এক
ঘন্টার বেশি ওই মরণযন্ত্রণা পায়নি সিম্বা। পেইন কিলার আরাম দিচ্ছে।
যত কিছু ক’রা সম্ভব
সব করছে ওরা। আর আমি ভাবছি ইমারজেন্সিতে আজ রাতটা থেকে একটু ভালো হ’লে কাল ওকে বাড়ির কাছের হসপিটালে ভর্তি ক’রে দেব। সে কথা বলতেই ডাক্তার ম্লান হাসল।
এক্সরের রেজাল্ট আসল। ওর পেটে নাকি একটা টিউমার হয়েছে। আর
তা ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে শুধু। এখন বুঝলাম। বাইরে থেকে রক্ত দিলেও চোখ মেলে
তাকাচ্ছে না কেন ও।
‘তোমরা
সার্জারি ক’রে দেখতে চাও?’
ষোল বছর বয়সে সার্জারি? ধকল সইতে পারবে ও? পারবে জেনারেল
এনাস্থিসিয়া সামলাতে? আমরা
পায়চারি করছি। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।
ডাক্তার আবার এল। ‘আসলে আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু নেই। সার্জারি করবার মত
অবস্থায় আর নেই ও। তোমরা যে বাড়ি থেকে বাচ্চাদের আনবে সে সময়ও নেই আসলে।’
আমি এদিকে তখনও ভাবছিলাম কাল বাড়ির কাছের হসপিটালটাতেই
নিয়ে যাব। দিনটা কাটিয়ে বিকালে বাড়ি। কয়েকটা দিন অফিস থেকে ছুটি নেব। ওর সাথে
থাকব সেরে না ওঠা পর্যন্ত। চোখের সামনের ছবিগুলো এত দ্রুত বদলে যায় মানুষের
জীবনে।
বাচ্চাদের বাড়ি থেকে আনতে পারলাম না। সিম্বার হাতটা শক্ত ক’রে ধরে থাকলাম। যেতে দেব
না ।রিডারস ডাইজেস্টে অনেক দিন আগে একটা কুকুরের গল্প
পড়েছিলাম। সেখানে বলেছিল সবচেয়ে বড় ভালোবাসা সেটাই যেখানে ছেড়ে দেওয়া যায়।
আমার ভালোবাসা কোনদিনই ঠিক অতটা বড় ছিল না।
বারোটা পয়তাল্লিশ। ১৫ই আগস্ট, ২০১২ সাল। সিম্বা চলে গেল।
আমি মাথায় হাত বুলাই। গায়ে হাত বুলাই।
এখনও শরীর গরম। লাল মা, হৈ, তাথৈ-কে নিয়ে এল বাড়ি থেকে। সবাই
ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
'আমরা কি
মাস ক্রিমেশন করতে চাই? নাকি ওকে
একা?' হ্যাঁ, একাই দিও। দল বেঁধে ‘ফুল তুলিতে যাই’ বলে তো আর আসেনি পৃথিবীতে! ওরা সাতদিন পর
আসতে বলল হসপিটাল থেকে সিম্বার ছাই নিতে।
ঘননীল ভেলেভেটে মুড়ে সিম্বার শেষটুকু পেলাম আমরা। সাথে
দিয়েছে লালচে ক্লে-তে ওর পায়ের ছাপ। বুকে ক’রে রাখব? প্রাণপ্রিয়
মৌসুমী আমায় বলল, ‘সিম্বা
কুকুরদের জগতে শতায়ু হয়েছে। অনেক যত্ন নিয়েছ তুমি। এর চেয়ে বেশি কুকুর তো বাঁচে
না।’
আজ দুই বছর পরের আর একটা ১৫ই আগস্ট। আমি ভোর ছয়টায় অফিস
আসি। সে সময় কুকুরদের ব্রাহ্ম মুহুর্ত। সবাই রাস্তায় হাঁটতে বের হয়েছে।
প্রতিদিনই রাস্তায় ওদের দেখে বুকটা খুশিতে ভরে ওঠে আমার। আজ দেখি একটা সোণালি ছোট্ট
প্রায় কাঠবিড়ালির থেকে অল্প বড় হ’বে, গাছে
অর্ধেক চড়ে বসেছে। গাছের মাথায় এক কাঠবিড়ালি এ ডাল থেকে ও ডাল। সোণালি ছোট্ট কী
অসম্ভব ভৌ ভৌ দিচ্ছে। আজ শিকার করেই ছাড়বে ওই হতচ্ছাড়া কাঠবিড়ালিটাকে। লীশ হাতে
ওর মানুষটার মুখে কী হাসি। খুব মজা পাচ্ছে কান্ড দেখে। আজ ওর দিনটা ভালো যাবে।
গাড়ি চালাতে চালাতে জামার ডান হাতের কনুই-এ চোখের জল মুছি। আমার যা ছিল তা আর
নেই।
আমাদের লেকটাউনের বাসার জানালাগুলোর কার্নিশ খুব চওড়া ছিল।
তা আবার গ্রীল দেওয়া। ছোটখাট বারান্দা বলে মনে হ’ত। আমার টংসা সিম্বার বারান্দা। ছেলেবেলায় ওদের ওখানে
দাঁড় করিয়ে নানা পোজে ছবি তুলতাম। একটা জানালা জুড়ে আমি করলা গাছ লাগিয়েছিলাম।
কি সুন্দর পাশ কাটা কাটা সতেজ সবুজ পাতা করলা লতার। হলদে ফুল ফুটে আছে। হালকা
গন্ধ। ছোট্ট সিম্বা সেই করলাগাছের সামনে। করলা ফুল দেখছে। এই ছবিটা আমার এখনকার
বাড়ির দেওয়ালে ঝুলে আছে। যে আসে সেই বলে, ‘তোমার বাড়ির দেওয়ালে মানুষের চেয়ে তোমার কুকুরদের ছবি
বেশি ।’ আমি হেসে বলি, ‘হৃত্পিন্ডে কামড় বসিয়েছে, পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা তো আসলে খুব
বেশি নয়।’
আঠারো বছর আগে হাতিবাগান থেকে এক অটোরিক্সায় চেপে আমরা
সিম্বাকে এনেছিলাম।
কোলে ক’রে ।
২০শে আগস্ট, ২০১৪
লিখতে লিখতে ২০১৪-এর ১৫ই আগস্টে পৌঁছে গিয়েছিলাম বলে
সিম্বার ছবির সামনে মোম জ্বেলে, ধূপ জ্বেলে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দু’ হাত ভর্তি আমার শাদা কারনেশন। নিঃশ্বাসটা বন্ধ হ’য়ে
গিয়েছিল। তবু জীবনটা মৃত্যুতে ঘুরে ঘুরে আবার জীবনে এসে থামে। সবসময়। হাঁটু
ভেঙ্গে পড়ে যায় মানুষ, আবার মাটিতে পড়ে থাকা গাছের একটা
ভাঙা ডাল ধরে উঠে দাঁড়ায়। যদি আজকের দিনে শুধুই চোখের জল থাকে, আগেকার কোন একদিনে যখন অনেক দোলনচাঁপা ফুটেছিল, আকাশে
গোলাপি মেঘ ছিল - সেইদিনে ফিরে গিয়ে দু’মুঠো ভর্তি দোলনচাঁপা হাতে
নিয়ে দাঁড়ায়। মানুষের গল্প ভেঙে পড়া মাটির ঘরের মাটি খাবলে ধরে, কোনমতে মাথাটুকু উঁচু ক’রে, ফুটো
হ’য়ে যাওয়া ছনের চালের মাঝ দিয়ে যে আকাশটুকু দেখা যায় -
সেই আকাশ দেখবার। ছনের চালের মাঝ দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখবার।
২৪শে আগস্ট, ২০১৪
যে গল্প বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলাম তার সালটা ছিল ২০০০।
টংসা সিম্বা আমার পা চেটে দিল। আমি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে, টংসা সিম্বার একটা
বাঁধানো ছবি নিয়ে হসপিটালে চলে গেলাম। চারপাশে বেবী পাউডারের গন্ধ ... ওদের
তুলতুলে ফোলা ফোলা গাল...ওদের মাথায় চুলবুলে চুল...
এদিকে আমার এত কষ্ট হচ্ছে যে আমি কাঁদতেও পারছি না।
মানুষের জন্ম কবিতার মত।
আসলে আমি ভাবতাম অরগানিক খাবারের মত যা কিছু স্বাভাবিকভাবে
জন্মায় নি তা ভালো নয়। পেস্টিসাইড কখনো ভালো হ’তে পারে? দেশে
কথায় কথায় সী সেকশনের ধুম দেখে মনে হ’ত এই সব ডাক্তারদের পয়সা রোজগারের ফন্দি ফিকির। মানুষকে
ডাকা হয়েছে। সে পৃথিবীতে চলে আসবে। জটিলতার তো কিছু নেই; এখানে ছুরি, কাচি, সাঁড়াশি-র জায়গা কোথায়? পাঁচদিন
ধরে ছটফট করছি। তবু আমাদের হৈ,
‘আর অল্প
একটু থাকি?’ আমি
এদিকে ঝান্ডা তুলে বলে চলেছি, ‘সী সেকশনের মত পরাজয় আমি মেনে নেব না।’ আমার অনেক অত্যাচার সহ্য ক’রে ডাক্তার
শেষে বলল আর কিছুক্ষণ দেরি করলে আমরা বাচ্চাকে বাঁচাতে পারব না। অবশেষে
আমি সী সেকশনের গ্লানি মেনে নিলাম। ছোট্ট হৈ-এর আকাশ ফাটানো চীত্কার
শুনে আমার দু’ চোখ দিয়েও
জল নামল। দেখি লালও আমার হাতটা মুঠো ক’রে ধরে আছে, দু’ চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আকাশ আর
পৃথিবী তো কান্নায় ভরে যাবেই। তারপর গানে। মানুষের জন্ম হচ্ছে যে।
আসলে আমরা তো ভাবিনি ছোট্ট হৈ সত্যি সত্যি আমাদের হাতের
পাতায় এঁটে যাবে। আমরা যে ওর জন্য ক্রীব কিনি নি, নরম পশমী কম্বল কিনি নি, কিনি নি নীল রঙের উলের টুপি। ও যে সত্যিই
আসতে পারে, ডাক্তার সে কথা আমাদের
নিশ্চিত ক’রে বলেনি।
শেষ পর্যন্ত একটা সত্যিকারের কবিতা লিখে ফেললাম।
এদিকে শরীরে নানা আগডুম বাগডুম বাঁধানোর জন্য বেশ কিছুদিন
হসপিটালে থাকতে হবে। টংসা সিম্বার জন্য মন কেমন করছে। বাড়িতে কেউ না থাকলে ওরা
খাবে না। প্রথম রাত মা বাড়িতে থাকল, লাল হসপিটালে। জানা গেল মনের দুঃখে টংসা
নাকি বসবার ঘরের কার্পেট ছিঁড়ে ফেলেছে। পরের রাতগুলো লালই বাড়িতে ছিল। মা আমার
কাছে। হৈ-এর কাছে।
এরপর হৈ-কে নিয়ে তো বাড়ি যেতে হ’বে। টংসা, সিম্বা সহ্য করবে ওকে? লাল প্রতিদিন হৈ-এর
বেবী পাউডার মাখা, দুধের
গন্ধ মাখা ওয়ানজি নিয়ে, ব্ল্যাঙ্কেট
নিয়ে বাড়ি যায়। টংসা সিম্বাকে হৈ-এর গায়ের নরম গন্ধ শোঁকায়। ‘আমাকেও দলে নিও। আমাকেও কাছে নিও।’ মানুষের শরীরের গন্ধ
কথা বলে।
হৈ তখন হামা দিতে শিখেছে। হঠাত্ একদিন দুপুরবেলা। সিম্বা
দৌঁড়ে এসে আমাকে ডাকছে। ভৌ, ভৌ, ভৌ। ধুপ করে শব্দ। গিয়ে দেখি হৈ বিছানা থেকে
মাটিতে পড়ে গেছে। আর টংসা পাশে বসে পাহারা দিচ্ছে। পড়ে গেছে, কিন্তু কিচ্ছু হয়নি হৈ-এর। পাখির ছানা
মাটিতে পড়ে গেলে এমনটা দেখেছি।
বহুদিন পর হৈ, তাথৈ যখন কথা বলতে শিখল, ওদের একটা গান শিখিয়েছিলাম । ওরা দু’জন টংসা, সিম্বার চারপাশ ঘুরে ঘুরে হাত পা নেড়ে
নেড়ে গান করত আর নাচ করত। ‘টংসা দাদা, সিম্বা দাদা কোথা থেকে এলে?’ সত্যিই তো, ওরা কোথা থেকে এল?
২৫শে আগস্ট, ২০১৪
গত এক বছর থেকে লাল বাড়ি দেখে যাচ্ছে। আর ভাড়া বাড়িতে
নয়। টংসা, সিম্বাকে নিয়ে টাউন হাউজই হোক আর যে হাউজই হোক, সম্মান
নিয়ে থাকাটা প্রায় অসম্ভব হ’য়ে পড়েছে। সত্যিই তো, ওরা কোথা থেকে এল? লাল শক দেয় না এমন কলার কিনে আনল। ভৌ
করলেই গলার কাছে জল স্প্রে ক’রে। শক দেওয়ার মত অমানুষিক
বার্ক কলার নয়। তখন টংসা সিম্বাকে জোরে ‘নো’ বলাটাও আমাদের কাছে অমানুষিক মনে হ’ত। তবে অনেক বছর
পর মানুষের ছানা মানুষ করতে গিয়ে মনে হয়েছে মাঝে মাঝে ‘নো’
বললে হয়ত ক্ষতি নেই। দু’ গালে দু’ চড় না মারলেই হলো।
কিন্তু জল স্প্রে ক’রে ওদের দমানো গেল না।
একটু থামে, তারপর ঘোড়ার মত ‘হ্রেস্বারবে’
আমাদের দিকে ব্যঙ্গের হাসি হাসে। শেষ
চেষ্টা হিসাবে লাল ওদের আবার একটা ট্রেনিং স্কুলে দিল। প্রতিদিন নিয়ে যায়। ওরা
ভদ্র হওয়ার ভান ক’রে। শেষদিন পরীক্ষা। অন্য একজন এসে ওদের
গা ব্রাস করবে। সামনে থেকে খাবারের থালা সরিয়ে নেবে। অন্যদের কুকুরদের সাথে খেলতে
হবে। ট্রেইনার লালকে বলল, ‘ওরা তো ক্লাসগুলো করেছে, পরীক্ষা আর দিতে হবে না। সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছি।’ বোঝা গেল, আমার কুকুর পরীক্ষা পাশ তো দূরের কথা,
পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করেনি।
হৈ-কে নিয়ে সারারাত দু’ ঘন্টা পর পর উঠে ক্লান্ত হ’য়ে বিছানায় মটকা মেরে পড়ে আছি। মাথার
কাছে টংসা, পায়ের
কাছে সিম্বা – সোনার কাঠি, রুপার কাঠি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি যে
জলাটা তার জলে যেন অল্প ঢেউ উঠেছে। জলার মধ্যে অনেক লম্বা, বড় বড় গাছ। কোন
পাতা নেই, কবে যেন
মরে গেছে। পাশে কোমড় সমান ঘাস। এ ঘাস কেউ কাটে না। সেদিনকার দুপুরে ঘাসের উপর
বয়ে যাওয়া বাতাসটুকুর কথা আজও মনে পড়ে। হাত পা অবশ হ’য়ে যায়। ও ভাড়া বাড়ি আমার ছিল না। তবু
যেন আমারই ছিল। যেখানেই যাওয়া সেখানেই সারা দেয়ালময়
পেইন্টিং ঝুলিয়ে, কাঁথা
ঝুলিয়ে, জামদানী
শাড়ি, শীতলপাটি
- সে বাড়িকে নিজের ক’রে তোলা।
অল্প কয়েকদিনের জন্য হ’লেও।
ফুলদানিতে বুনো ফুল। তারপর ছেড়ে যেতে এত কষ্ট! যেন হাতের পাতা পেরেক দিয়ে কেউ
ভালবাসার উপর গেঁথে দিয়েছে। হাতটা সরিয়ে তুলতে গেলেই রক্ত ঝরবে।
পঁচিশে আগস্ট, দু’ হাজার চোদ্দ সাল। ভাবিনি এ দিনটিও সত্যি
এসে যাবে। এত তাড়াতাড়ি। আর সবচেয়ে আশ্চর্য, যে দিনে এসে এ গল্প হোঁচট খেয়ে পড়ল, সেদিন এই বাড়ি কিনবার কথা বলতে শুরু
করেছিলাম। অথচ সত্যিকারের জীবনে তার মাঝে বারো বছর কেটে গেছে। সেদিন যে বাড়ি
কিনেছিলাম, তার চাবি আজ অন্যদের হাতে
তুলে দিচ্ছি। হৈ হাই স্কুলে যাবে। গ্রামের মাঝের এই বাড়ি থেকে ও যে হাইস্কুলে
যেতে চায়, সেখানে যাওয়া যাবে না। ফুল, প্রজাপতি, বুনো ঘাসের গন্ধে
ভেজা দিন আমাদের ছেড়ে প্রয়োজনীয়তার দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। বাড়ির ক্লোজিং আজ।
কিন্তু আমার কাছে বাড়িও যে মানুষের মত। মানুষ কি কেনাবেচা
হয়? মানুষের বুকে আলো, হাওয়া
খেলে; বাড়ির বুকেও জানালা দিয়ে। ‘ওল্ড
ম্যান অ্যান্ড দ্যা সী’। হাঙর ধেয়ে আসছে। আর
সান্তিয়াগো... “ ‘Ay,′ he said aloud. There is no
translation for this word and perhaps it is just a noise such as a man might
make, involuntarily, feeling the nail go through his hands and into the wood.”
আসলে আমরা কোনরকম হ্যান্ডিম্যান না ব’লে সেই দেড়শ বছরের পুরানো, দু’শ একরের ফার্মহাউজ কিনবার সাহস হয়নি।
কিন্তু সেই ব্ল্যাক সুজানের নেশা আমাদের পিছু ছাড়েনি। হরিণের চোখ যে একবার দেখেছে, সে হরিণ ছাড়া কিভাবে বাঁচে? মুঠো মুঠো
রাতের জোনাকি মুঠো মুঠো ভাতের মতই জরুরি। অনেক খুঁজে খুঁজে একটা বাড়ি পাওয়া গেল।
শহর থেকে দূরে। তবে অনেক দূরে নয়। আশেপাশে খুব কেউ নেই।
ম্যাডিসন ছোট শহর। সবাই এখানে যে যেখানে যেতে
চায়, পাঁচ, দশ, পনেরো মিনিটের মধ্যেই যেতে পারে। আমাদের
এই নতুন বাড়ি সবকিছু থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট মত দূরে। তবু , আমাদের ক্ষমতার মধ্যে শহরের কিছুটা
কাছাকাছি সেই ফার্মহাউসের মিনি রেপ্লিকার মত আর কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না। কিনে
ফেললাম বাড়ি। প্রথম বাড়ি প্রথম প্রেমের মত। সেখানে লাভ-লোকসানের হিসাব থাকে না।
দুই একর জমি বাড়িতে। এক একর জুড়ে বুনো জঙ্গল। বসন্তে আমরা
জংগলে ঢুকতাম। অন্য সময় গাছে গাছে এমন জড়াজড়ি ক’রে থাকত যে ভালো ক’রে কোন একটা গাছের সাথে কথা বলা যেত না। কিন্তু বসন্তে নতুন
পাতার ভালোবাসা আমাদের শরীর জড়িয়ে উঠত। জমির মাঝ দিয়ে গেছে ছোট নদী ইয়াহারা।
আমি ওকে ধানসিড়ি ব’লে ডাকতাম।
বাড়ির নামও দিয়েছিলাম ধানসিড়ি। কাঠের গুঁড়ি থেকে খানিকটা কেটে তাতে ‘ধানসিড়ি’ খোদাই ক’রে বাড়ির বেড়ায়, দরজার মুখে
ঝুলিয়েছিলাম। বাড়ির পিছনে নেইবারের সাতাশ একর জমি। সেখানে হরিণ খাবার খেতে আসে।
পড়ে থাকা স্বপ্নের মত, খেয়ে যায়
ঝরে পড়া ফসলের দানা।
সে বছর গল্পের বই থেকে চোখ তুলে অনেক খুঁজেও বাচ্চারা কোথাও
কোন রেইনডিয়ার খুঁজে পেল না। খ্রীস্টমাসের সময় আমি ওদের বললাম, এই হরিণগুলোই রেইন ডিয়ার। সন্ধ্যার দিকে
ওরা সেই রেইনডিয়ারদের জন্য খাবার দিয়ে এল। বাড়ির উপর দিয়ে উড়ে যেতে গিয়ে
সান্তা যেন দুধ, কুকি আর
রেইনডিয়ার দানা খাওয়ার জন্য শুধু একটু থামে। আর থামলেই তো খ্রীস্টমাসের দিন
ভোরবেলা খ্রীস্টমাস ট্রির পাশ ঘিরে ঝিলিমিলি কাগজে মোড়া উপহারের বাক্স। নানা
ধর্মের উত্সবগুলো, আনন্দগুলো
গায়ে মেখে নিতে শিখলে হয়ত একদিন বড় হয়ে ওরা ধর্ম নিরপেক্ষতার মত কঠিন
শব্দগুলোর সহজ মানেটা শিখবে। হানুকার মেনোহ্রা নিজে নিজে জ্বলে না।
বাড়ি তো পাওয়া গেল, কিন্তু এত্ত হাই মেইনটেনেন্স! শনিবার
বা রবিবার আমাদের কেটে যেতে থাকল বাড়ির ঘাস কেটে। রাইডিং লন মোওয়ারেও এত্ত সময়
লাগে? উইকএন্ডে
কেউ ফোন করলেই, ‘কি করছি? ঘাস কাটছি।’ আর নয়ত লাল বাড়ির সুইমিং পুলের জল
সবুজ থেকে নীল করছে। বাচ্চাদের ভায়োলিন, পিয়ানোর ক্লাশ শহরে, বহুদূরে।
গরমকালে একরকম কিন্তু শীতকালে? উইস্কনসিনের
বরফ ঠেঙ্গিয়ে, রাতেরবেলা
বরফে পিছল রাস্তায় স্কিড ক’রে প্রায়ই গাড়িতে তিনশ’ ষাট ডিগ্রী গোল গোল ঘুরে বাড়ি এসে
পৌঁছানো। আমি প্রায় প্রতি রাতেই বাড়ি এসে বলতাম, ‘আর একটা দিন বাঁচলাম।’ লালের গাড়ি ব্ল্যাক আইসে পিছল খেয়ে
চুড়মাড় হ’য়ে ভেঙ্গে গেল। গাড়িতে
বাচ্চারা ছিল। মিরাকলের মত কারো কিছু হ’ল না, শুধু
গাড়িটা গেল। তবে গ্রাম ব’লে রক্ষা।
রাস্তায় আমাদের গাড়ি ছাড়া আর কোন গাড়ি ছিল না। শহরের অসংখ্য গাড়ির ভিড়ে
এমনটা হ’লে আর দেখতে হ’ত না। ‘পা ফসকে আলুর দম।’
তাথৈ-এর জন্ম এই গ্রামের বাড়িতে। রাজকন্যা আমার! বাংলাদেশ
থেকে মা-র সাথে আমার দিদাও এসেছিল তাথৈ-এর জন্মের সময়। হসপিটালে ডাক্তার দিদার
কথা শুনে এত্ত আশ্চর্য হ’য়ে
গিয়েছিল। ‘তোমাদের কালচারে এত্ত সময় দেও তোমরা
অন্যদের জন্য?’ অন্য
কোথায়? প্রৌপুত্রী!
এদিকে দিদা তো আমার স্বাবলম্বী। ফেব্রুয়ারী মাস, চারদিক বরফে ঢাকা। তবে বরফ ব’লে রোদের অভাব এই উইস্কনসিনে কোনদিন
হয়নি। মন খুশি ক’রা সোণালি
ঝলমল রোদ দেখে দিদা তার শাড়ি আর লাল ডোরা কাটা গামছা ডেকে মেলতে যাবে। যতই বলি
ওখানে শুকাবে না। দিদার যুক্তি,
‘সূর্য তা হ’লে আছে কেন?’ সত্যিই তো
বরফের দেশে সূর্য এমন আছে কেন? স্নান ক’রে কাপড় মেলে দিল দিদা। বিকালবেলা গর্বভরে সে কাপড় এনে
ঘরে আনতেই দেখে পাপড়ভাজার মত শাড়ি, গামছা। আর একটু পর ঘরের গরম পেয়ে সে
পাপড়ভাজা হাঁটু ভেঙ্গে চুরচুর। আবার সেই ভেজা তেনা শাড়ি। তেনাই বটে। দিদা বলে
তেনারসী। ঘর তো দূরের কথা, বিয়েবাড়ি
যেতে নিলেও সবসময় মা মাসীকে দেখেছি দিদা কোন শাড়ি পড়বে তা নিয়ে নানা সাধাসাধি।
যুদ্ধ।
এই নতুন বাড়ি এসেই টংসা, সিম্বার জন্য লাল ফেন্স দেওয়া শুরু করল।
একটু আধটু কাজ নাকি সেটা? এক একর
জমি ফেন্স দেওয়া হ’বে। আমার
প্রাণের ভয় এই বুঝি ওরা হারিয়ে গেল, এই বুঝি ওরা ছুটে গেল আর ওদের গাড়ি
চাপা দিয়ে দিল। কয়েকজনের কাছে গল্প শুনেছি তাদের কুকুর হারিয়ে গেছে, তাদের কুকুর গাড়িচাপা পড়েছে। ঠিক হ’ল ছয় ফুটের পিকেট ফেন্স হ’বে। হৈ, তাথৈ এত ছোট যে ওদের নিয়ে দিনেরবেলা
ফেন্সের কাজ ক’রা যায়
না। লাল বাচ্চারা ঘুমালে ফেন্সের কাজ শুরু ক’রে। মশার স্প্রে আর হিন্দী গান নিয়ে। হিন্দী গান শুনলে
নাকি ঘুম পায় না। আমি তো এদিকে জীবনবাজি ক’রে রেখেছি। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া আর কোন গান শুনব না। মাথার
ভিতর কেমন একটা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া আর কিছু শুনলে ঠিক
মানুষ হওয়া যাবে না। জীবনে বহু আঁতলামো ক’রে বহু পরে বুঝেছি মনুষত্ব ঠিক অতটা ঠুনকো নয়।
হিন্দী গানের তালে তালে ফেন্সের কাজ চলছে। পরদিন ঘুম থেকে
উঠে আমার সুপ্রিয় নেইবার ও পরম বন্ধু ডেবরা বলছে, ‘এ কী! কাল রাতে তো কিছুই ছিল না এখানে। এখন তো দেখছি দু’টো সেকশন হ’য়ে গেছে।’ তবু অফিস ক’রে, দু’টো হাঁটুসমান মানব সন্তানকে সামলে ফেন্স
শেষ করতে লালের প্রায় দু’ দু’টো গরমকাল লেগে গেল।
কিন্তু শুধু ছয় ফুট ফেন্স দিয়ে ক্ষান্ত হ’লাম না আমরা। অফিসে কেন যেন একটা বোনাস
পাওয়া গেল। যদি টংসা সিম্বা ছয় ফুট ফেন্সের নীচ দিয়ে গর্ত ক’রে দৌড় দেয়! বিশেষতঃ, বিচ্ছু টংসা? ‘পেটসেফ’-কে ডাকিয়ে
এক একর জমিতে ফেন্সের নীচ দিয়ে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে ইনভিজিবল্ ফেন্স ইনস্টল ক’রা হ’ল।
টংসা, সিম্বাকে
যে আগলে রাখতেই হবে। যে ভাবেই হোক।
ফেন্স যেদিন শেষ হ’ল লাল ওদের ছেড়ে দিল। মুক্ত স্বাধীন বলাকার মত। কোনদিন
এতটা জায়গাতে ওদের লীশ না দিয়ে ছাড়তে পারি নি আমরা। এদেশে ছেলেমেয়েদের
হার্ভার্ডে পড়বার পুরো কলেজ মানি দিতে পারলে যেমন লাগে বাবা, মা-র, আমার তেমন লাগল। আর টংসা, সিম্বার দৌড় দেখব কী, লালের ঠোঁটের কোণের নীরব হাসি দেখে আমি
ভাবলাম, ‘নিজে নিজে মাটি খুঁড়ে, সিমেন্ট দিয়ে, হাতুড়ি, পেরেক মেরে দু’ বছর কাটিয়ে দেওয়ার এই কষ্টকে আসলে কোন
কষ্টই বলে না।’ গলার
কাছটায় কি যেন আটকে গেল। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না।
অসাধারণ! পাড়া প্রতিবেশীকে না জ্বালিয়ে এবার ওরা বরফের
ভিতরও বাইরে যেতে পারবে। শুধু ওদের পেট সমান যখন উঁচু হয় বরফ, একটু বরফ সরিয়ে ওদের
জন্য পথ কেটে দেই। জানুয়ারী মাসে দশ ডিগ্রী ফারেনহাইট(মাইনাস বারো পয়েন্ট বাইশ
ডিগ্রী সেলসিয়াস)হ’লে ওরা
অল্প গিয়ে পা ভেঙে পড়ে যায়। তখন কোলে ক’রে বাইরে নিয়ে যেতে হ’য় টংসা সিম্বাকে। কিন্তু তা না হ’লে ওরা দু’জন এতদিনে এক একরের ভিতর মুক্ত স্বাধীন। আমাদের অন্য একরে
হরিণ ঘুরুক।
ভোর হ’লেই
ফেন্সের ভিতর মার্চপাস্ট ক’রে মাঠে
ঘুরে বেড়াই আমরা। আমার সেনাবাহিনীতে আছে হৈ, তাথৈ, টংসা, সিম্বা। তাথৈ যদিও এক পা দু’ পা যেতেই ধুপ
ক’রে মাটিতে বসে পড়ে। ভালো ক’রে হাঁটতে শিখে নি। হৈ ভালো করে হাঁটতে
শিখেছে। ফলে সে শুধু ফুল তুলতে চায়। আমি আমার মাঠভর্তি ড্যানডিলাইন দেখিয়ে দেই। ‘ভুলেও সত্যিকারের ফুলের বেডের পাশে যেন এস
না’। তবে ড্যানডিলাইন অসাধারণ
ঘাসফুল। ছোট ছোট সোণালি সূর্যের মত। ছোট্ট হৈ আমার মা-কে ‘দাদীন’ নামে ডাকে। ও ড্যানডিলাইন ফুলের নাম দিল ‘দাদীন ফুল’। আমার বাবা যখন মারা যায়, মা’র বয়স তখন সাতাশ। ছোট বোনের বয়স দুই। মা-র মত
উজ্জ্বল মানুষ আমি আর কোথাও কোনদিন দেখি নি। মানুষ জীবনে নিজ নিজ ছেলে মেয়ে নিয়ে
অনেক গর্ব ক’রে। আমি
আমার মা-কে নিয়ে গর্ব ক’রি। জন্ম দিলেই
তো আর মা, বাবা হ’ওয়া যায় না! প্রত্যেক সিংহাসনে বসবার
জন্য জীবনের সোনার মুকুটটি জীবন দিয়েই যোগাড় করতে হ’য়।
আমি এখানে ফুলগাছ লাগাই। সেখানে ফুলগাছ লাগাই। আমার খোঁড়া
মাটিতে টংসা, সিম্বা আরো খুঁড়ে
আরো খানিকটা বড় গর্ত ক’রে। তবে ওরা কোনদিন গল্পের বই-এর
মত আমার বাগানের টিউলিপ উল্টে ফেলে তা ধামাচাপা দিতে টিউলিপের শিকড় আকাশমুখো ক’রে গুঁজে দেয়নি। মনে হয় ওরা শুধু জীবনভর
মাটির ভিতরের কেঁচোর পিছনে তাড়া করেছে। পাশ দিয়ে সাপ চলে গেছে।
স্লিপ-ওভারে এ বাড়িতে হৈ, তাথৈ-এর বন্ধু এলে ওরা জোনাক পোকা ধরে। শহরের
আলোয়, ওদের
বাড়ির পাশে যে জোনাকপোকা ভয় পায়। জোনাক পোকা আসে না।
আমি লালের জন্মদিনে একটা উইপিং উইলো লাগালাম। বড় প্রিয়
গাছ। হৈ স্প্রিং বেবী ব’লে প্রতি
বছর ওর জন্মদিনে ফলের গাছ লাগাই। প্লাম, চেরী, পিয়ারস কত বড় হয়েছে আজ। যখন আঙ্গুরলতা
লাগিয়েছিলাম, লাল বলেছিল পাঁচ বছরের আগে তো
ফল দেবে না। আমেরিকায় কেউ পাঁচ বছরের বেশি নাকি এক বাড়িতে থাকে না। বারো বছর
কেটে গেছে এই একই বাড়িতে আমাদের। গত বছর সাতাশ একরের নেইবার এসে বলল, ‘আমরা তোমাদের আঙ্গুর গাছ থেকে বুশেল খানেক
আঙ্গুর তুলেছি। খুব ভালো ওয়াইন করেছি। তোমাদের দেব।’
চারদিকে নানা পাখির জন্য নানা রকম খাবার দিয়েছি আমি। কাঠের
বাসা দিযেছি ফেন্সে। এ বাড়ির বাগানেও এখন ব্লু-জে, লাল কার্ডিনাল, গোল্ড ফিঞ্চ, কালো ছিট ছিট ডাউনি
উডপেকার, লাল
ছোঁওয়া শাদা বুক গ্রসবীক, নিঝুম
দুপুরে মন খারাপ করা একটানা সুরে গান গাওয়া ঘুঘুপাখি, ছটফটে
চিকাডি, পাখায় আকাশের নীল আর বুকে
সূর্যাস্তের হলুদ নিয়ে উড়ে যাওয়া ব্লুবার্ড। আমার লাগানো দারুচিনি
রঙের বার্চ গাছ …প্রায়
ফার্ম হাউজের মতই তারা জ্বলা রাত। ঘরের দেওয়াল জুড়ে নকশী কাঁথা, জামদানী শাড়ী।
কিছুদিন হ’ল নারকেলের
নাড়ু বানাতে শিখেছি।
‘আমার বাড়ি
যাইও ভোমর,
বসতে দেব পিঁড়ে,
জলপান যে করতে দেব
শালি ধানের চিঁড়ে।
শালি ধানের চিঁড়ে দেব,
বিন্নি ধানের খই,
বাড়ির গাছের কবরী কলা
গামছা বাঁধা দই।’
বাড়ির চাবি তুলে দিচ্ছি পরের বাড়িওয়ালার হাতে আর আমি
ভাবছি হৈ, তাথৈ খুব ভালোবাসে আমার
বাগানের কুমড়ো ফুলের বড়া।
২৬শে আগস্ট, ২০১৪
টংসা সিম্বা এতটাই আমার পুরোটা পৃথিবী যে ওদের কথা শুরু
করলে শেষ করতে পারি না। তখন কোলকাতার লেকটাউনে থাকি। আমার ছোটবোন শ্যামার বিয়ে।
বাড়িতে বাংলাদেশ থেকে আমার সব মামা, মাসী, দাদু, দিদা, মাসতুত ভাই বোন।
টংসা সিম্বা বছর খানেকের। যেই আসে তার গায়ে ভালোবাসায় লাফ
দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর আমার বাংলাদেশের সব আত্মীয়স্বজন ‘বাবাগো মাগো’
বলে পিছু হঠে। কেউ কেউ প্রায় মূর্ছা যাওয়ার যোগাড়। এমন কি আমার
ছোটবোন শ্যামাও। কুকুরে সকলের মারাত্মক ভয়। এ বাড়িতে বড় হ’য়ে আমি যে কিভাবে কুকুর না দেখলে মূর্ছা যাই, সেটা
ভেবে দেখবার বিষয়। বিয়ের কনের পছন্দটা সম্মান ক’রা দরকার।
বাড়ির অতিথিও সবাই যেন হোটেলে না চলে যায়। রায়ের ফল হ’ল
টংসা সিম্বার রাজত্ব সারা বাড়ি থেকে গুটিয়ে লক্ষণ রেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ ক’রে দিতে হ’বে। আমাদের বেডরুম আর বারান্দা ওরা পাবে।
এদিকে আমার প্রাণ উচাটন ক’রে। বাড়ির লোকজন বিয়ের
বাজার করতে গেলে , সাইট সিইয়িং করতে গেলে মাঝে মাঝেই মওকা
বুঝে আমি ওদের আবার পুরো বাড়িতে ছেড়ে দেই। ছোটমাসীর ছোটমেয়ে রূপকথা এখন বড়োটরো
হ’য়ে এদেশে এসে গুরুগম্ভীর এমএস, পিএইচডি
নামক সব মহাযন্ত্রণাতে ভর্তি হ’লেও তখন খুব ‘বারবি’ নিয়ে খেলত। একদিন ‘বারবি’-কে বিছানায় শুইয়ে সবাই তো গড়িয়াহাটে গেছে। কয়েকজন আর একটু স্টাইল
করতে দক্ষিণাপণ। বিয়ের দিন সেজেগুজে কাঁপিয়ে দেবে। আর আমাদের টংসা? বেডরুম থেকে ছাড়া পেতেই কথা নেই বার্তা নেই ভৌ দৌড়। অল্প সময়ের জন্য হ’লেও বন্দীদশা ঘুচেছে আজ। ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও, বাঁধ ভেঙ্গে দাও, ভা---ঙ্গো’।
মাসীর বিছানা বরাবর তাক ক’রে এক লাফে ‘বারবি’-র স্লিম ফিগারের একটা হাত দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে
নিয়ে আমাদের সুপারম্যান টংসা উধাও।
দক্ষিণাপণ থেকে জামাকাপড় নিয়ে ফিরে এসে রূপকথার সে কি
কান্না! কে বলে মানুষ ভৌ ভৌ করতে পারে না! কি হ’ল? কিভাবে
হ’ল? মাসী উত্তর দিল, ‘মশা ছিনিয়ে নিয়েছে।’
লেকটাউনে তখন সত্যি সত্যি চড়ুইপাখি নামের উড়ন্ত বলাকার মত
মশা ছিল। তার মধ্যে কবিবর আমি আবার আলো বাতাস না পেয়ে দমবন্ধ হ’য়ে যাওয়ার
ভয়ে মশারি ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছি। রাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠলে কয়েলের
মাথায় জ্বলে থাকা লাল আগুন চেয়ার টেবিলের গায়ে হোঁচট খাওয়া থেকে রক্ষা করত।
সবুজ রঙের কছুয়া(কচ্ছপ) ধূপ।
৩০শে আগস্ট, ২০১৪
৩০শে আগস্ট, ২০১৪
এদেশে এসে কমফর্টার কার্পেটে পেতে শুয়ে থাকবার দিন থেকে
পরিস্থিতি এখন একটু ভালোর দিকে। এবার কিছু ফার্নিচার কেনা যাবে। কাঠের কিনব? টংসা সিম্বার
যে এখনো দাঁত নিশপিশ। যদিও সেই কবে দাঁত পড়েছে। ছোট ছোট মুক্তার মত? কুকুরেরও যে দুধের দাঁত পড়ে জানতাম না। ছানা আমার। নাহ্, রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। বসতে গেলাম চেয়ারে, হয়ত
অর্ধেকটা পা চিবিয়ে রেখেছে টংসা, আর পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি
দিয়েছে সিম্বা। সুবিধা হ’বে না। ওক কাঠের ভারি ভারি
ফার্নিচার বিক্রী ক’রা দোকান থেকে দূরে থাকলাম। এসব
ফার্নিচার এত মজবুত যে হেয়ারলুম ক’রে বংশানুক্রমে চালান করে
দেওয়া যাবে। কিন্তু ঘুনপোকার পরিবারে কাঠের বনেদী ময়ূর পালঙ্ক চলবে কি? আমার কুকুরছানা জাগুয়ারের মত খাবল মারে, দাঁত দিয়ে
শানিয়ে নেয় নিজ অস্ত্বিত্ব। খোঁজখবর নিলাম স্ক্যান্ডিনিভিয়ান ফার্নিচারের দোকান
‘রুবিন্সে’, ‘আইকিয়ায়’। এমন ফার্নিচার
দেখলেই আমি আশ্চর্য হ’য়ে যাই। খড়কুটো দিয়ে ভারি সস্তায় অপূর্ব
দেখতে দোলনা বানিয়ে ফেলেছে? নাহ্, ‘উহা
সত্যিকারের বেড’। নানা দোকান ঘুরে ঘুরে কিছু টেবিল চেয়ার
ফুটন পাওয়া গেল। একদম উপযুক্ত। লোহার পা সবগুলোর। ছানাদের দাঁত ভেঙ্গে যাবে,
চেয়ার ভাঙবে না।
গরমকাল এসেছে। প্রতি উইকএন্ডেই প্রায় দেখি প্রতিবেশীরা
বেড়াতে বেড়িয়ে পড়ে। লং উইকএন্ড হ’লে তো কথাই নেই। আমরাও যাব
টংসা সিম্বাকে নিয়ে? কিন্তু যেসব হোটেলে কুকুর রাখে তার
সংখ্যা যে খুব কম, দাম বড় বেশি। আর ওরা রাখে স্বল্পভাষী, নীচু স্বরে
কথা বলা অসম্ভব সব ‘পোলাইট’ ডগদের।
বাঙাল, ঘটিদের জায়গা নেই। ‘কাইজ্যা
কইরাই’ ‘দিন যেতে বসেচে গো দিদি’! কেনেলে
রেখে যাব? তখনো সেই প্লেনে কাটানো একটা রাত ছাড়া কোন আর
একটা রাত একা কাটায়নি ওরা। ঠিক হ’ল ক্যাম্পিং করা হ’বে। তারপর থেকে কত কত তারাজ্বলা রাত কেটে গেছে আমাদের ওদেরকে নিয়ে। মাটির
উপর সবুজ রঙ্গের টেন্ট, তার ভিতর বিছানা। চারপাশে মশার
কামড়। এঁকেবেঁকে চলছে পেট মোটা, লেজ সরু পোকামাকড়। মাঠ
জুড়ে প্রেইরী। সোণলি কালো ব্ল্যাক সুজান, গোলাপি বেগুনি গে ফেদার, বেগুনি কালো কোন ফ্লাওয়ার,
কুলম্বাইন, লুপাইন। বসন্তে বনের বুক ঢেকে প্রায়
চোখে পড়ে না এমন ছোট ছোট হারিয়ে যাওয়া গল্পের মত ফুটে আছে হালকা নীল রঙের ফরগেট
মি নট। মাঝখানে হলুদ টিপ। লেকের জলে সাঁতার কাটা। টংসা
সিম্বার জন্য আবার সেপারেট বীচ। পেট-রা সাঁতার কাটবে আর একে অন্যকে ভৌ দেবে।
রান্না করছি হয় খিচুড়ি নয় টপ র্যামন নুডলস। মাঝে মাঝে চিকেন বারবিকিউ কিংবা
সসেজ। পঞ্চপদ রান্না করবার ব্যবস্থা নেই, সময়ও নেই। দূর
থেকে জল টেনে আনতে হয়। জংলী পথে, পাহাড়ি ঢালে ‘হাইক’ ক’রা ছেড়ে দিয়ে
রসগোল্লা বানাব? কি জানি হয়ত অতটা বাঙ্গালী তখনও আমরা ছিলাম
না। রাতে ক্যাম্পফায়ারের আগুনে মার্শমেলো দিয়ে ‘স্মোর’
বানাচ্ছি। তখনও ভীগান হইনি আমি। হর্সহুফ ব্যবহার করে বানানো
মার্শমেলো কোন দুঃশ্চিন্তা না করেই টপাটপ। টংসা সিম্বা আগুনের পাশে আরাম ক’রে বসে আছে। কি জানি ওদের রক্তের ভিতর পূর্বপুরুষের স্মৃতি বুদবুদের মত
ভেসে উঠছে কিনা। সেই কবে মানুষ আগুন ঘিরে বসে থাকত। শিকার শেষে। পাশে তার কুকুর। ‘চিরসখা’।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে বনের পথে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে যাই।
ফেলে আসা জীবনের স্বপ্নের মত বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কথা মনে পড়ে। বুনো গন্ধ নাকে এসে লাগে।
বাতাসে একটা ভেজা ভেজা জল জল মত। হাতের মুঠোয় শ্যাওলার মত নরম সবুজ সবকিছু। লালের
হাত ধরে থাকি। আমার অন্য হাতে টংসার লীস, লালের হাতে সিম্বার।
ঘুমানোর সময় আমরা টংসা সিম্বাকেও টেন্টের ভিতর টেনে নেই। রাতের জঙ্গলের কু নজর না
লাগে।
৩১শে আগস্ট, ২০১৪
৩১শে আগস্ট, ২০১৪
যখনই টংসা সিম্বা ঘুমায় আমি চারবার ক’রে ওদের দেখে
আসি। নিঃশ্বাস বন্ধ হ’য়ে যায়নি তো?
নাহ্, পেটটা ওঠানামা করছে। ওদের তুলতুলে কালো
থাবা হাত দিয়ে চাপ্পু করি। নাহ্, কোনরকম জ্বর
আসেনি। নাকটা এখনো বেশ কালো কুচকুচে আছে। কে যেন বলেছিল কুকুরের যখন নাক কুচকুচে
কালো থাকে তখন ওদের বয়স বেশি হয়নি। তখন ওদের কোন অসুখ করেনি। অবশ্য
আমাদের টংসার ভঙ্গি দেখে দূর থেকে বলে দেওয়া যায় যে ও বড় নিশ্চিন্তে আছে। যখনই
ঘুমায় চার হাত পা শূন্যে ছড়িয়ে, নরম শাদা পেটটা আকাশের
দিকে তাক ক’রে নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়ে। কোনরকম কোন চিন্তা নেই
ওর জীবনে। শুনেছি কোন প্রাণী যখন কোনরকম থ্রেটেন্ড ফীল না ক’রে
একমাত্র তখনই পেট দেখিয়ে ঘুমায়। তা না হ’লে শত্রু এলে বড়
অসহায় সে অবস্থা যে তার।
দেখতে
দেখতে হৈ-ও বড় হ’য়ে গেল। অন্নপ্রাশন করতে হ’বে। আমি এদিকে ভাই, বোনের অধিকার নিয়ে ভীষণ রকম
ঝান্ডা তুলে বেড়ানো মানুষ। ধর্ম নিয়েও। ভাইফোঁটা আমার বড় প্রিয় অনুষ্ঠান। আর
হাতে গোনা যে কয়েকটা আছে তা হ’ল খ্রীস্টমাসে ফায়ারপ্লেসের
ম্যান্টেলের উপর স্টকিং ঝোলানো। ভিতর পর্যন্ত দেখা যায় এমন কাঁচের তৈরী নানা
অর্নামেন্ট দিয়ে ঝাউগাছের ডাল সাজানো...নীল পাখি ...লালের গায়ে কালো ফুটি
কাঁচপোকা। স্কুলের খ্রীস্টমাস শপিং-এর দোকান থেকে
ছেলেবেলায় তাথৈ আমার জন্য এক ডলার দিয়ে কিনে এনেছিল। বড় প্রিয় বৌদ্ধ পূর্ণিমার
চাঁদ দেখা। ঈদের প্রায় ক্ষীর হ’য়ে যাওয়া ঘন দুধের সেমাই খাওয়া। টুপটুপে
ফুলে ওঠা কিশ্মিশ তাতে। প্রিয় হানুকায়
মেনোরাহ্ জ্বালানো। কিন্তু ভাইফোঁটা প্রিয় বলেই ভাই-এর কপালেই বুঝি ফোঁটা পড়বে?
অমল ফোঁটা পাবে। বসুন্ধরা কি দোষ করেছে? আমিনা?
মঈন? ভাইফোঁটার ছড়া বদলে ফেললাম।
ভাই-এর কপালে দিলাম ফোঁটা
যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা
বোন-এর কপালে দিলাম ফোঁটা
যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা
আমিনা, যোসেফ,
ম-ঈন, হানা ব্লুমিংস্টিং-এর
কপালে দিলাম ফোঁটা
যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
যম দেয় যমুনাকে ফোঁটা
যম যেমন অমর
আমার ভাইও হোক তেমন অমর
যমুনা যেমন অমর, আমার
বোনও হোক তেমন
অমর, ভাই-বোনের
কপালে দিলাম ফোঁটা
যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা।
প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে আসা ভাইফোঁটা নিয়েই আমার এই দুরাবস্থা, আর জীবনে
একবার হ’বে যে অন্নপ্রাশন, তা নিয়ে তো
মহাকাব্য লিখতেই হ’বে। আমার নিজের ভাই নেই। অন্নপ্রাশনে মামা
মুখে ভাত দেয়। তাতে কি? হৈ-কে বোনের বাড়ি নিয়ে চললাম।
মাসী অন্নপ্রাশনের প্রথম অন্ন দেবে। যদিও আমি তখন পায়েশ রাঁধতে জানতাম না।
ক্রকপটে পায়েশ নাম নেওয়া বিদেশী কিছু একটা বানিয়ে ফেললাম। হৈ-কে তাই দেওয়া হ’ল। লাল হৈ-এর জীবনের প্রথম বড় অনুষ্ঠানে পোর্টল্যান্ড আসতে পারল না। টংসা সিম্বাকে বেবীসীট করতে
ম্যাডিসনে থেকে গেল।
আর একবার লালের বন্ধু দেশ থেকে কেন্টাকীতে এসেছে। পাঁচশ
পনেরো মাইল ড্রাইভ ক’রে প্রিয় বন্ধুকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এল
লাল। সেই উইকএন্ডেই আবার ফেরত দিতে যাবে। এবার আমিও চেপে বসলাম গাড়িতে। ঘন্টা নয়
চালিয়ে লাল গেল, বন্ধুকে ড্রপ করেই আবার আমরা ফিরতে শুরু
করলাম আর একটা নয় ঘন্টার ড্রাইভ সামনে নিয়ে। ট্রাক ড্রাইভারের মত এমন কত যে আমরা
করেছি। বন্ধুকে দেখতে গেছি, আত্মীয় স্বজন। কিন্তু একটা রাত
কোথাও থাকিনি। ঘরে টংসা সিম্বা আছে।
আসলে কিছুতেই প্রাণে ধরে টংসা সিম্বাকে কেনেলে দিতে
পারছিলাম না আমরা। এ দেশে আসবার পর তিন বছর হ’য়ে গেছে। দেশে যাই নি।
আসবার পর পরই না হয় পয়সা ছিল না। কিন্তু তারপর? দেশ থেকে
ফোন আসে। তোরা কি শেষপর্যন্ত কুকুরের জন্য দেশে আসবি না? আর
কত নাটক করবি? নাহ্, আর নাটক করব না।
কেনেল ব্যাপারটা খুঁজে বুঝতে হ’বে এবার। দু’ হাজার এক সালের মার্চমাসে আমার জীবনের লেখা প্রথম জ্যান্ত কবিতা হৈ-কে
দেখাতে ওকে নিয়ে একা দেশে গেলাম। লাল টংসা, সিম্বাকে নিয়ে
উইস্কনসিনে থাকল। হৈ-এর প্রথম জন্মদিন মিস করল। এখনো বরফ চারদিকে। কেনেলে
বেশীদিনের জন্য ওদের রাখতে মন সায় দিল না। বরফের ভিতর তো নয়ই। অবশেষে মে মাসের
শেষে লাল তিন সপ্তাহের জন্য টংসা, সিম্বাকে প্রথমবারের মত
কেনেলে রেখে দেশে গেল। বিশ্বাস হয়নি কোনদিন আমরা
সত্যি সত্যি ওদের কেনেলে রাখতে পারব।
তবে ফোন ক’রে কেনেল থেকে খবর পেলাম। ওরা ভালো আছে। বরফ
গলছে উইস্কনসিনে। মে মাস। টংসা নাকি কেনেলে ওর ঘরের সামনে ছড়িয়ে পড়া অল্প রোদ্দুরে
বসে আছে।
হৈ, তাথৈ অল্প বড় হয়েছে। খ্রীস্টমাস বুঝতে
শিখেছে। ঠিক হ’ল এবার থেকে খ্রীস্টমাস ট্রী সাজানো হ’বে। এতদিন এদেশে এসে খ্রীস্টমাস আর থ্যাঙ্কসগিভিং-এর সময় আমি খুব মন
খারাপ ক’রে ঘুরতাম। অন্য সবাই আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব
নিয়ে বাড়ির ভিতর আনন্দ করছে। ওদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। কেউ হয়ত পিয়ানো
বাজাচ্ছে, সাথে কেউ গান গাচ্ছে
‘I'm
dreaming of a white Christmas
Just
like the ones I used to know
Where
the tree tops glisten
And
children listen
To hear
sleigh bells in the snow’
নিজেকে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের ‘দ্যা লিটল
ম্যাচগার্লের’ মত মনে হ’ত। খালি পায়ে
যেন এক একটা ম্যাচ জ্বালিয়ে দেখছি, জানালার কাচের ভিতর
দিয়ে বরফ শাদা টেবিলক্লথ, টেবিলের উপর রোস্ট ক’রা হাঁস, আপেল আর ড্রাইড প্লাম দিয়ে স্টাফিং তার।
ধোঁয়া উঠছে গরম খাবার থেকে। লিটল ম্যাচগার্লের মত কানা
কড়ি নেই, এমন
অবস্থা নয় আমার। কিন্তু
আমার যে আশেপাশে কোন আত্মীয় নেই, কোন প্রাণের বন্ধু নেই।
ম্যাচস্টিক জ্বালিয়ে ওদের জীবন ছাড়া আমি তো আর কিছু দেখি না। শুধু জানালার কাচের
ভিতর দিয়ে বরফ শাদা টেবিলক্লথ, টেবিলের উপর রোস্ট ক’রা হাঁস, আপেল আর ড্রাইড প্লাম দিয়ে স্টাফিং তার।
ধোঁয়া উঠছে গরম খাবার থেকে।
তোড়েজোড়ে ট্রী সাজাতে শুরু করলাম। ছয় জোড়া স্টকিং এল।
সকলের নাম লেখা। সিম্বার স্টকিং শ্যাওলা সবুজ রঙের ভেলভেটের। তাতে সোণালি সূতায়
এমব্রয়ডারি ক’রে ‘সিম্বা’ লিখে দিলাম। টংসার স্টকিং কালচে লাল রঙের ভেলভেটের। তাতেও সোণালি
সূতা দিয়ে লিখলাম, ‘টংসা’। তারপর থেকে
প্রতি বছর ভেলভেটের উপর জরির সূতায় আমাদের খ্রীস্টমাসের গল্পও বোনা হ’তে থাকল।
এত কিছু বলছি, এত কিছু লিখছি শুধুমাত্র
এইজন্য যে আমি টংসা, সিম্বা আর আমাদের জীবনের এই অংশটুকু
কিছুতেই লিখতে পারছি না। এ পর্যন্ত কতবার চেষ্টা করলাম। যতবারই শুরু করি ল্যাপটপ
বন্ধ ক’রে উঠে যাই।
২০০৫ সাল। থ্যাঙ্কসগিভিং-এর আগের দিন। ডাক্তার তো বলেই
খালাস যে আর কুকুর ঘরে রাখা যাবে না। লালের লাং পাওয়ার ৫০% হয়েছে শুনে আমার
বন্ধু, বান্ধব, আত্মীয় স্বজন সবাই আমাকে বলে, ‘চিন্তা ক’রে দেখ কি করবে।’ অনেকে
তো আকার ইঙ্গিতে জানাতেও ভুলল না যে কুকুরের থেকে মানুষের জীবনের দাম বেশি। তোমার
হাজব্যান্ড আগে? না খেলবার কুকুর আগে? বুঝতে
পারছ যে একটা মানুষ মেরে ফেলতে যাচ্ছ?
আমি মানুষ বা কুকুর কাউকেই দাঁড়িপাল্লাতে তুলতে পারলাম না।
কলিজা রাখব না হৃত্পিন্ড?
ডিসেম্বর এসে গেল। কিছুই ঠিক করতে পারছি না।
আচ্ছা, ওদের যদি মাঠে একটা ঘর ক’রে দেই? উইস্কনসিনে এবারের শীতেই মাইনাস পঞ্চাশ
ডিগ্রী ফারেনহাইট (মাইনাস পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াস) হয়েছিল। এমন ঠান্ডা
প্রায় বছরই পড়ে। এখানে কুকুরকে বাইরে রাখা যায় না।
দিশাহারা হ’য়ে গাড়ি নিয়ে অচেনা
রাস্তা দিয়ে ঘুরছি। পথ না চিনে একই রাস্তায় বারবার ফিরে আসছি। আজ খুব রোদ উঠেছে।
গাড়ির ভিতর রোদের তাপ এসে গায়ে লাগছে। তারপর কত বছর কেটে গেছে। তবু সেদিনের সেই
রোদের তাপটুকু এখনো আমার শরীরে। স্বপ্নের উত্তাপ মানুষ ভোলে না। আমি ভাবলাম,
বাড়িতে না হয় ওদের রাখতে পারব না। যদি গাড়ির ভিতর রেখে দেই?
গাড়ি চালিয়ে রাখলে তো হীটিং পাবে। আর যদি সেদিন সূর্য ওঠে,
তবে তো কথাই নেই।
ভেটের কাছে গেলাম। উইস্কনসিনে অনেকেই ঘোড়া পোষে। একজনের
সাথে কথা হ’ল। ওর ঘোড়ার ঘরে শীতকালে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করেছে। ফার্মে এমন
সম্ভব।
আর মাঠের মধ্যে আগুন জ্বেলে না হ’য় রেখে
দিলাম। আমাদের দেখতে না পেয়ে ওরা কি একটা শীতকালও পার করতে পারবে?
গ্যারেজে রাখলে কেমন হ’য়? একটা
পোর্টেবল হীটার জ্বেলে? আমরা যখন অফিস থেকে ফিরব, ওরা আমাদের দেখতে পাবে।
ফোর সিজন রুম যারা বানায়, তাদের কাছে গেলাম। কাচের
ঘর বাড়ির সাথে। সারা বছর বাইরের প্রকৃতি দেখা যাবে। হীটেডও থাকবে। হয়ত সবসময়
বাইরেটা দেখতে পাবে ব’লে আমাদের জন্য মন খারাপ করবে না।
কমপক্ষে দশ হাজার ডলার লাগবে সানরুম বানাতে। আমি কোথায় এ ধরনের পয়সা পাব?
এখানকার চাকরি ছেড়ে টেক্সাস চলে যাব? গরম জায়গা।
হয়ত সারা বছরই বাইরে রাখা যাবে ওদের।
আচ্ছা, যদি হিউম্যান সোসাইটিতে দেই আর আমিও সেখানে
ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করি? ওদের ঘর ঝাড়ু করবার সময় নাহয়
ওদের সাথে একটু বল নিয়ে খেলব। লাল রঙের বল। হয় না এমন?
কিন্তু ওরা তো টংসা, সিম্বাকে নেবে না। যে যে
পরীক্ষাতে বসবারই সুযোগ পায়নি টংসা সিম্বা ছেলেবেলায়, সেইসব
পরীক্ষা দিয়েই ঢুকতে হবে হিউম্যান সোসাইটিতে। অন্য
একজন এসে ওদের গা ব্রাস করবে। সামনে থেকে খাবারের থালা সরিয়ে নেবে। অন্যদের
কুকুরদের সাথে খেলতে হবে। “ট্রেইনার লালকে বলল, ‘ওরা তো ক্লাসগুলো করেছে, পরীক্ষা আর দিতে হবে না। সার্টিফিকেট
দিয়ে দিচ্ছি।’ বোঝা গেল, আমার কুকুর পরীক্ষা পাশ তো দূরের কথা, পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করেনি।”
আর এও তো ঠিক, নয় বছরের কুকুরকে এডপ্ট
করবার মত বেশি লোক পৃথিবীতে নেই। ছোট্ট পাপি বাড়ির বাচ্চাদের সাথে বেড়ে ওঠে।
একসাথে ‘ফেচ’ খেলে।
নানা এডপশন সেন্টারের খোঁজ নিলাম। খ্রীস্টমাসের কাছাকাছি।
এডপ্ট করতে দিতে চায় যে সব কুকুর, তাদের লাল রঙের সোয়েটার,
মাথায় রেইনডিয়ার শিং পরিয়ে ছবি তোলা হয়েছে। পাশে সবুজ রঙের
কম্বল। উলের নরম কম্বল পাশে থাকলে ভালোবাসা বোঝায়। কুকুর, বিড়াল
তাড়াতাড়ি এডপ্ট করে নেয় মানুষ। লাল রঙের সোয়াটার, মাথায়
রেইনডিয়ার শিং পরা কুকুরের ছবির মাথায় লেখা আছে, ‘হোম ফর
দ্যা হলিডেইস’। নিয়ে চল, আমাদের
খ্রীস্টমাসের সময় নিয়ে চল। তারপর আমার নতুন ফ্যামিলির সাথে খ্রীস্টমাস ট্রী-র
পাশে ছবি তুল। পরের বছর খ্রীস্টমাস কার্ডে তোমাদের সাথে
আমিও থাকব। ‘ওহ্, তোমরা নতুন কুকুর এনেছ বুঝি?’
আমি টংসা সিম্বাকে কতটুকু ভালো বেসেছিলাম যে এত কষ্ট আমার
পেতে হ’বে?
কোথাও দিতে পারলাম না ওদের। আমাদের লিভিং রুমটা ছেড়ে দিলাম
। ফুটনে বালিশ, খেলনা দিয়ে বিছানা। ওই ঘরে ডগিডোর বসানো হ’ল। লিভিং রুমের সামনেই কভারড পোর্চ। সেটাও ওদের দিলাম। তার পাশে ছোট ঘেরা
দেওয়া ফেন্স। আমরা যখন অফিস যাই, তখন ওরা ওই ফেন্সে ঘুরতে
পারে। সবুজ ঘাস। আর অফিস থেকে ফিরলেই ওদের সেই লালের বানানো ছয় ফুট ফেন্স দেওয়া
এক একরে ছেড়ে দেই। আমরা ওদের সাথে মাঠে গিয়ে খেলি। তারপর সবাই সাবান দিয়ে হাত
ধুয়ে ঘরে ঢুকি। কুকুরের ছোঁয়া যেন লালের গায়ে না লাগে।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আমার এক বন্ধু এসে বলে গেল, ‘আরে এত মন
খারাপ করছিস্ কেন? আমার ডর্মরুম তো তোর কুকুরের ঘর থেকে
ছোট।’
‘হ্যাঁ, পরের জন্মে
আমার কুকুর হ’য়ে জন্মাস।’
লোহার আড়াই ফুট মত গ্রীলের দু’টো রুম ডিভাইড
করে দেয়, এমন গেট দেওয়া হ’ল টংসা,
সিম্বার ঘরের সাথে আমাদের। ওরা আমাদের সবসময় দেখতে পায়। খালি এ ঘর,
ও ঘর ঘুরতে পারে না। আমাদের সাথে ঘরের ভিতর খেলতে পারে না। আমরা যখন
খেতে বসি, লুকিয়ে লুকিয়ে পায়ের নীচে পড়ে যাওয়া সব খাবার
চেটেপুটে সাবার ক’রে দিতে পারে না। ওরা আমাদের সাথে আর এক
বিছানায় ঘুমায় না। সোনার কাঠি, রুপার কাঠি।
আজকাল আমরা যখন বাড়ি ফিরি, বহুদূর থেকে আমাদের
গাড়ির শব্দ বুঝতে পেরে টংসা সিম্বা ওদের নিজেদের ঘরে বসে ভীষণ খুশি হ’য়ে লেজ নাড়ে আর ভৌ ভৌ ক’রে। উপর তলায় মেন গেটের
কাছে গিয়ে লাফালাফি ক’রে চারপাক ঘুরে নিতে পারে না। তবুও
ওদের মানুষ ঘরে ফিরেছে।
৩রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪
৩রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪
সব সময় ভাবতাম আমি খুব সহজেই একদম গপ্ ক’রে কষ্ট গিলে ফেলতে পারি। ইজেল, তুলি, ক্যানভাস, রঙ নিয়ে গ্রীল দেওয়া গেটের ভিতর টংসা, সিম্বার ঘরে ঢুকে পড়লাম। মানুষের নিজের
কাছেই যে কষ্ট গিলে ফেলবার জলটুকু আছে।
একটা যেন ঘর। চারপাশে বসন্তের ছোট ছোট ঘাসফুল ফুটে আছে।
ফুলের পাশ ঘিরে বরফ গলা জল। একটা বেড়া। বেড়ার ওই পাশটায় সূর্যের আলো পড়ে না।
সেখানে বরফ গলেনি। কোথায় যেন দেখেছিলাম ছবিটা। নাকি দেখিনি। আঁকতে শুরু করলাম।
ঘাসফুলগুলো টংসা সিম্বার ঘরের পাশ ঘিরে ফুটছে।
হৃত্পিন্ড উপড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে
গলার গান থেমে যাবে, এমন তো
নয়। যা কিছু ভালোবাসি, সব সব
টংসা সিম্বার চারপাশ ঘিরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসলাম। বাড়ির অন্যান্য ঘরে, আমার পৃথিবীতে আর ওরা ঘুরতে পারে না ব’লে ওদের ঘরেই আমার সংসার।
লিভিংরুমটা বেশ বড়। ফলে ছাদসমান র্যাক জোগাড় ক’রে তাতে নানা সবুজের চাষ শুরু করে দিলাম।
এই শীতের দেশে কত কী যে লাগিয়ে ফেলেছি ছোট ছোট টবে। ফ্লোরেসেন্ট লাইট আমার সূর্য।
কমলা রঙের জবা ফুটে আছে। গন্ধরাজ কি শেষ পর্যন্ত ফোটাতে পেরেছিলাম? মনে আছে অনেক বেলী ফুটেছিল। জুঁইফুলও
ঘরের ভিতর। যতটা সময় কারো গাছে জল দিতে লাগতে পারে, তার প্রায় দ্বিগুণ সময় নিয়ে জল দেই।
সিম্বা জিহ্ববার আগাটা দিয়ে পায়ের পাতা অল্প অল্প চেটে দেয়। টংসা চারপা আকাশে
তুলে উলটো হ’য়ে আমার আঁকা ছবি দেখে।
বোদ্ধা সমালোচক।
দুর্ভাগ্যকে প্রায় ভাগ্য ক’রে ফেলেছি।
দেখতে দেখতে বছর তিন কেটে গেল। আগে যখন ওরা আমাদের সাথে
ঘুমাত, যদি ভুলেও কোনদিন
দরজার ওপারে থেকে যেত আর বাতাসে দরজা বন্ধ হ’য়ে যেত, কী কুঁই কুঁই। অথচ আজকাল একবারের জন্যও
কাঁদে না। যেন আমাদের পায়ে পায়ে থাকবার কোন কথাই ছিল না ওদের। এক ফুঁয়ে সব মন
খারাপ উড়িয়ে দিল আমার টংসা, সিম্বা। কী জানি হয়ত জীবনটা
বাতাসে উড়ে যাওয়া কাপাস তুলাই আসলে। কোথাও গাছের পাতায় জড়িয়ে গেলে একটু থামতে
হয়। তারপর আবার পরের ঝটকায় পথ।
গত কয়দিন ধরে টংসাটা ওর ঘরে যে পাপাসন চেয়ার দিয়েছি তা
থেকে আর নামছে না। ও অবশ্য সবসময়ই একটু রাজকীয় চালে চেয়ারে বসে থাকতে ভালোবাসে।
আর সিম্বা মাটিতে। আদুরে টংসাটা খাচ্ছেও না কিছু। জ্বর হয়েছে? থাবা চাপ্পু ক’রে দেখি। নাহ্, গরম না।
নাকটা ঘষে দেখি। একই রকম কুচকুচে কালো।
লাল ডাক্তারের রিপোর্ট নিয়ে এসেছে। আমাদের টংসার ক্যান্সার
হয়েছে। বোন ক্যান্সার। আমি আমার কুকুরদের সারা জীবন জংলী ক’রে রেখেছি। কোনদিন মানুষের মত ভদ্র হ’তে দেইনি। ওদের কেন মানুষের অসুখ হ’বে? মনে হ’ল আমি বুঝি সমুদ্রের উপর দাঁড়িয়ে আছি। জলের উপর মানুষ
কখনো খালি পায়ে দাঁড়াতে পারে?
অথচ আমি প্রতিদিন ওর গায়ে হাত বুলিয়েছি। কিছুই বুঝতে
পারলাম না? ডাক্তার বলল ওর নাকি
সাতদিন মত আয়ু আছে। এক সপ্তাহে সাতদিনই তো সময়। নাকি? ভালোবাসার আয়ু কিভাবে সাতদিন হ’তে পারে?
বোন ক্যান্সারে নাকি বড় ব্যাথা। প্রত্যেক পা ফেলায় হাড়
ভেঙ্গে যাওয়ার মত কষ্ট হয়। থাক্, লাফ দিয়ে
আর বিছানায় ওঠবার দরকার নেই। মাটিতে তোষক পেতে দিলাম ওকে। কোনদিন মাটিতে কাপড়ের
ডগি বেড পেতে দেই নি, বিছানা ছাড়া শুতে
দেই নি ওদের। আস্তে আস্তে এসে টংসা মাটির বিছানায় শুয়ে পড়ে এখন। হয়ত কষ্ট একটু
কম হ’য় এভাবে।
ডাক্তার বলে চলেছে, ‘ওকে পুট
টু স্লীপ করতে চাও? পুরো লাঙে ছড়িয়ে
গেছে ক্যান্সার।’ চোখের উপর টিওমার। বারো বছর বয়স।
সার্জারীর ধকল নিতে পারবে কিনা জানি না। আর সার্জারী যদিও ক’রে, একটা চোখ নাকি কেটে বাদ দিতে হ’বে। ‘তাও কোন লাভ হ’বে কিনা বলতে পারছি না।’ থাক, আমার টংসাকে শেষ সময়ে আর অত কষ্ট দিও না
তোমরা। পুট টু স্লীপ করতে হ’বে না। ওকে নিজের মত যেতে
দাও। আমি আমার নিজের হৃতপিন্ডটা দু’ হাতের ভিতর নিয়ে বসে
থাকলাম। দু’চোখ দিয়ে জল ঝরে যাচ্ছে।
সারাজীবন কত চিন্তা করেছি, ‘এই বুঝি টংসা সিম্বা হারিয়ে গেল। এই বুঝি গাড়ি চাপা পড়ল।’ ছয় ফুট পিকেট ফেন্স কোন পাগলে দেয়? সাথে আবার মাটির নীচের ইনভিসিবল্
ফেন্স। আমার জীবনের সবটুকু জমিতে ছয় ফুট ফেন্স দিয়ে এবার আর ওকে ধরে রাখা যাবে
না। ‘দুষ্টের শিরোমণি, লঙ্কার
রাজা’ আমাদের দুরন্ত টংসা। যে কোন রকম সুযোগ পেলেই সে শুধু ছুটে পালিয়ে যায়।
সেই ছেলেবেলা থেকে। এবারের এই সু্যোগ ও ছাড়বে কেন?
প্রায় সারাটা দিনই টংসা শুয়ে থাকে। সিম্বা টংসাকে চেটে
চেটে আদর ক’রে দেয়। সিম্বাটা সবসময়ই এমন। ওর ভিতর
কেমন যেন একটা মা মা ভাব আছে। টংসাটা এদিকে পড়ে পড়ে আদর খায়। লজ্জা
পর্যন্ত নেই।
আমি রাতে মাটিতে টংসার পাশে এসে শুই। ওর গায়ে গা ঘেঁষে।
ভাবি যদি আমার শরীরের আয়ু থেকে ও একটু আয়ু পায়। এইসব রূপকথায় হ’য়। সোনার কাঠি, রুপার
কাঠি। সত্যিকারের জীবনে একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে বিদ্যুত্ চলে যায় না।
ওকে অরগানিক সব্জি দিয়ে, মাংস দিয়ে
খুব নরম ক’রে ভাত ক’রে দেই।
দোকানের ডগফুড আর নয়। কে বলতে পারে? হয়ত ক্যানের ডগফুড খেয়েই ক্যান্সার
হয়েছে। সবকিছু স্টীলের বাসনে। শুনেছি প্লাস্টিক ব্যবহার করলে নাকি ক্যান্সার হয়।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ লিডাম দেই। যেখানে যা কিছু শুনি একটু
ভালো হ’বে, সব জোগাড়
ক’রে ফেলি। মেল অর্ডারে সব অল্টারনেটিভ
মেডিসিন। কিনে আনি ফ্ল্যাক্সসীড। অফিস আসবার আগে ফিস্ ওয়েল হাতের তালুতে নিয়ে
ওকে একটু খাওয়াই। টংসা আস্তে আস্তে চেটে ফিস্ ওয়েল খায়। সারাদিন ওর জিভের নরম
ছোঁয়াটুকু আমার হাতে লেগে থাকে। একটু যেন ভালো মনে হচ্ছে? আমি কি তবে ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার ক’রে ফেললাম? বিশ্বাস
হ’য় সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। কিছুতেই
টংসা মরে যাবে এমন তো হ’তে পারে না।
ডাক্তার বারবার বলছে যখনই তোমরা মনে করবে চলে এস। পুট টু
স্লীপ করলে ও কষ্ট পাবে না। একটা সময়ের পরে আর কষ্ট দেওয়া ঠিক না। হ্যাঁ, মৃত্যুর ওপারে তো কোন কষ্ট নেই। আরো বলল
যদি দেখ কাশির সাথে রক্ত উঠছে, তাহলে আর কোনরকম দেরি কর না।
লাংস থেকে এমন হবে।
মাথা নীচু ক’রে খেতে ওর
কষ্ট হচ্ছে আজকাল। একটা ছোট স্ট্যান্ডের মত কিনলাম। তার উপর বাটি দিলে একটু আরাম হ’বে। আমি ভাবতাম টংসা নীল রঙ পছন্দ ক’রে। ওর কলার, লীশ সব
নীল রঙের কিনেছিলাম। পেটস্ মার্ট থেকে নীল রঙের ভীষণ সুন্দর একটা তুলতুলে ভেড়া
কিনে আনলাম। আগে হ’লে টংসা তার উপর গড়িয়ে পড়ত। এখন জিভ
দিয়ে আলতো ক’রে ভেড়ার কান দু’টো অল্প চেটে দিল।
আমি অফিস থেকে এসে টংসার পাশ থেকে নড়িনা। বাইরে কোথাও যাই
না। ওকে চাপ্পু ক’রে ধরে রাখব। কিছুতেই যেতে দেব না।
কাজলদা বললেন, ‘খেয়াল
রেখ। যদি ও মাথাটা ঝুলিয়ে দেয় বিছানা থেকে, তার মানে
খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। ওরা ব্যথা তো বলতে পারে না। ওমন ক’রে মাথাটা ঝুলিয়ে রাখে।’
ডাক্তার পেইন কিলার দিয়েছে। মরফিন? কি জানি! ‘এখন আর কিছু তো করবার নেই। মানুষের হস্পিস্ কেয়ারের মত
যত্ন নেওয়া শুধু। পেইন কিলার দিয়ে যতটা কষ্ট কম দেওয়া যায়।’
আমি লালকে বলি এত কড়া ওষুধের সাইড ইফেক্ট তো অনেক। ভালো
করছি কি? ‘ও এখন সাইড
ইফেক্টের অনেক বাইরে চলে গেছে।’ এই বলে লাল
টংসার জন্য ‘বেগিং স্ট্রিপস্’ নিয়ে আসে।
আগে কত ভাবতাম আমরা। ‘বেগিং স্ট্রিপস্’ গুনে গুনে দিতাম। এসব ট্রীট বেশি খাওয়া
ভালো না। টংসা ‘বেগিং স্ট্রিপস্’ পেলে গোল গোল ঘুরে, লেজ টেজ নেড়ে কী মহাকান্ড যে করত। আমি
ছেলেবেলার মত ওকে গাজর খেতে দিলাম। চোখ ভালো হ’বে। ওর গাজর চিবানোর মত অতটা শক্তি আর নেই। টংসা ‘বেগিং স্ট্রিপস্’ জিভ দিয়ে
ছুঁয়ে দেখল না। সময় হ’য়ে গেছে।
আমরাও মন শক্ত করতে থাকলাম। হয়ত পুট টু স্লীপই করতে হ’বে। মৌসুমী বলল, ‘আর একটু
দেখ’। ও আর কাজলদা ওদের কুকুর উইনির জন্য কী না
করেছে। কতবার হসপিটালে, কতবার অক্সিজেন দিয়ে আর একটু ভালো রাখা।
উইনি চলে যাওয়ার পর ওর জন্য আমি একটা গ্র্যানি স্মিথ আপেল গাছ লাগিয়েছিলাম।
বসন্তে গাছ ছেয়ে গোলাপি আপেলের ফুল ফুটলেই উইনির খ্রীস্টমাস কস্টিউমের কথা মনে পড়ত।
কি মিষ্টি যে লাগত ওকে ওই পোশাক পড়ে।
আমার মামাতো ভাই অয়নের কুকুর ব্রাউনি খ্রীস্টমাসের দিন হারিয়ে গেল। তখন হৈ হ’বে। রাতেরবেলা চমকে চমকে ঘুম ভেঙ্গে উঠি। ব্রাউনি কি এল? প্রায় পনেরো বছর হ’য়ে গেছে। ব্রাউনি এখনো আসেনি।
আমি আগে কুকুরের মৃত্যু দেখিনি। আমার মেজমাসীর কুকুর সুজিই
প্রথম। ও জয়, শুভ, মৌটুসীর
কুকুর। পুরানো ঢাকা থেকে মার্বেল পাথরে লিখিয়ে এনেছিলাম,
Suji
“I’m sure there’ll be place for you
In heaven’s bright tomorrow…”
1988-21st April 2001
মাথার কাছে অনেক দোলনচাঁপা লাগানো হ’য়েছিল।
প্রত্যেকদিন মনে হ’তে থাকল, নাহ্, আজ নিয়ে
যাই। ইউথেনসিয়া। তারপর মনে হ’য় আর একটু দেখি। যে জীবন আমি
দেই নি সে জীবন কিভাবে ছিনিয়ে নেব? যেটুকু
বেশি আলো দেখতে পেল সেটুকুই তো।
এক সময় জল খাওয়াও বন্ধ ক’রে দিল
টংসা। লাল বলল প্রাণীরা যখন মারা যায়, খাওয়া
দাওয়া বন্ধ ক’রে দেয়। শরীর এত দুর্বল হ’য়ে যায় যে কষ্টটুকু অনুভব করবারও আর শক্তি থাকে না।
তবে আমাদের টংসাও পারে। ইস্টারের দিন। বাইরে ওকে রোদে
রেখেছি। সবুজ জ্যাকেটটা পরনে। হঠাত্ ও প্রচন্ড জোরে ভৌ ভৌ ক’রে ঠিক আগের মত ফেন্সের পাশ দিয়ে দু’টো কুকুর যাচ্ছিল বলে তাদের তাড়া ক’রে ফিরে এল। কান্ড দেখে আমরা না হেসে পারি না। একটা গাড়ি
বহু বছর থেকে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হর্ন বাজায়। অল্পবয়েসী
একটা ছেলে ড্রাইভার। টংসা শব্দ শুনেই তেড়ে ফুঁড়ে যায়। খুব মজা লাগে হয়ত
চালকের। আজও হর্ন দিয়ে চলে গেল। টংসার কী লাফ ঝঁপ। ও কি ভালো হয়ে গেল? অনেক পরে বুঝেছি ও শুধু এই একটা ভৌ
দেবে ব’লে আমরা ওকে ডাক্তারের হাতে ইউথেনসিয়ার
জন্য তুলে দিতে পারি নি। সেদিন মার্চ মাস হ’লেও মাঠের
বরফ অনেকটা গলে গিয়েছিল। সুন্দর রোদ উঠেছে। উইস্কনসিনের কনকনে হাওয়া হাড়ের ভিতর
ঢুকে গিয়ে বলছে হাড়ের চারপাশ ঘিরে রক্ত আছে। জীবন।
আমি বাইরে গেছি। এসে দেখি টংসা ডেকে বালিশে মাথা রেখে ঘুমের
ভিতর চলে গেছে। ২৯ শে মার্চ, ২০০৮ সাল, বিকাল পাঁচটায়।
শেষ মুহূর্তে আমি ওর কাছে ছিলাম না। কে যেন বলেছিল যাকে খুব
ভালোবাসা যায় সে কাছে থাকলে ওরা যেতে পারে না। ডাক্তার বলেছিল সাতদিন। আমার টংসা
একুশ দিন বেঁচেছিল। কাজলদা গায়ত্রী মন্ত্র পড়লেন। আমার মত নাস্তিকের ঘরের
কুকুরের জন্য গায়ত্রী মন্ত্র পড়বার লোক এ পৃথিবীতে খুব বেশি নেই।
লোহার মত ভারী লাগছে শরীর। এক গ্লাস জল খেলাম। টংসার গলা থেকে নীল রঙের
কলারটা খুলে সিম্বার গলায় পরিয়ে দিলাম। দশদিন বয়স থেকে টংসা আছে সিম্বার সাথে।
সব সময়। লাল সিম্বাকে টংসার গন্ধটা শোঁকাল। প্রাণীরা নাকি মৃত্যুর গন্ধ চেনে।
সিম্বা নাকি টংসাকে আর খুঁজবে না। আমাদের সিম্বা তারপরও পুরো দু’ সপ্তাহ ধরে টংসাকে খুঁজেছে। যে প্রিয়
ব্লু স্প্রুসের নীচে বরফের ভিতরও টংসা বসে থাকত সেখানে বারবার ঘুরে আসে। মাটি
খুঁড়ে দেখে। টংসা চলে যাওয়ার পর আর চার বছর বেঁচেছিল সিম্বা।
আমি টংসার জন্য একটা ছোটমত হেডস্টোন কিনে আনলাম।
“If tears could build a stairway,
And memories a lane,
I'd walk right up to heaven
And bring you home again.”
প্রথম এই বাড়িতে এসে যেখানে ওদের লিশ দিয়ে আটকে রাখতাম
ঠিক সেখানে একটা পিন ওক গাছ লাগিয়েছি । হেমন্তে পিন ওকের টকটকে লাল পাতা মাটিতে ঝরে পড়ে । বেশ বড় হয়েছে গাছটা। প্রতি
বছর বসন্তে ব্লু স্প্রুসের নীচটা ঘিরে ‘ফরগেট মি নট্’ লাগাই । গাছের নীচটা কার্পেটের মত ছেয়ে বুকে হলদে
ফোঁটা নিয়ে ফুটে থাকে নীল রঙের ফুল। টংসার বড় প্রিয় ছিল এই ব্লু স্প্রুস গাছটা।
রাস্তা দিয়ে যখন যাই কারো কুকুর দেখলে আজকাল আমি একটু
দাঁড়িয়ে থাকি। আর কোন প্রাণী পুষি না। বনের পাখীদের খাবার দেই। ওদের হাত দিয়ে
ছুঁই না। কুড়িটা মত নানা রকম বার্ড ফীডার জড়ো করেছি। প্রত্যেক পাখির জন্য আলাদা
আলাদা খাবার। সানফ্লাওয়ার সীড, স্যাফলা সীড। হামিংবার্ডদের
জন্য লাল নেক্টার। ওরিয়লের জন্য কমলা। থিসল খেতে ভালোবাসে গোল্ডফিঞ্চ।
কাঠবিড়ালিগুলো এসে পাখির খাবার খেয়ে যায়। কট্নটেইল র্যাবিট আর জ্যাক র্যাবিট মানুষ
দেখলেই নড়াচড়া ভুলে দাঁড়িয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে একটা বুনো তিতিরও আসে।
Chomotkar hoyeche. Moner modhye chobi eke dichche jeno.
উত্তরমুছুন