পাতার শব্দ
হৈ তখন খুব ছোট। টলমল
হাঁটতে শিখেছে। তাথৈ স্ট্রলারে বসে চলাফেরা ক’রে। হাঁটতে পারেনা। দুই প্রাণের
কুকুর টংসা, সিম্বা, হৈ আর তাথৈ কে নিয়ে
বাড়ির ভিতর, বাড়ির সামনের মাঠের ভিতর আমার জমিদারি, আমার সাম্রাজ্য। তবে প্রতিদিন সকাল
হ’লেই এই দলবল নিয়ে আমার একটা জরুরি কাজ ছিল পাড়া দেখতে বেড়ানো। কোথায় কোন আগাছায়
ফুল ফুটেছে। কোন পাখি ডিম পেড়েছে। কাদের বাচ্চা ডিম ফুটে বেড়ুল, কারা উড়তে শিখল। কোন মনার্ক প্রজাপতি কোন মিল্কউইডে রাজত্ব বাড়াচ্ছে। মনার্ক ক্যাটারপিলার ক্রিসালাস তৈরী করল কিনা। একদম ভিতর পর্যন্ত দেখা যায় এমন স্বচ্ছ সবুজ অদ্ভুত কচিকলাপাতা রঙ তার। মাথার কাছে একটা করে সোণালি রিং- যীশুর মাথার হেলোর মত। আর আমার মাথার ভিতর, ‘We
do not inherit the earth from our ancestors; we borrow it from our children.’
সেদিনও সকালে ওদের নিয়ে গেছি
বাড়ির নদীটা দেখতে। ইয়াহারা নাম। এই নদীর ধারে একটা খুব বড় হিকরি গাছ আছে। আমরা প্রতিদিন
ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। একদম চুপ করে। কান পেতে শুনি।
হৈ-কে জিজ্ঞাসা করি,‘কিসের
শব্দ, হৈ?’
‘পাতার শব্দ!’
ছোট্ট হৈ-এর কাছে শোনা এই
‘পাতার শব্দ’ কথাটা আমার মনে এমন দাগ কেটে গেল। সেই তো। পাতার শব্দ। একটু চুপ ক’রে
থাকলে, শান্ত হ’য়ে একটু কান পেতে রাখলে পাতার শব্দ শোনা যায়। যেন জঙ্গলের মাঝে
দাঁড়িয়ে আছি। আকাশ ছাড়িয়ে গাছ। আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় না কোথায় সে গাছের
শেষ। শন্শন্, শন্শন্।
প্রকৃতির শব্দ চিরদিনই আমায়
মোহমুগ্ধ ক’রে।
কিরির্, কিরির্। ক্র্যাক্।
বরফের ভারে ডাল ভেঙ্গে পড়বার শব্দ। উইপিং উইলো-র বড় বড় ডালে বরফ জমেছিলো। নরম পায়ে চুপিচুপি হেঁটে যাওয়ার মত, আকাশ থেকে কাপাশ তুলা
ঝরে পড়বার মত শব্দ। চারদিকে ডাল থেকে বরফ ঝরে পড়বার শব্দ। বরফ পড়ছে। শান্ত
স্বপ্নের মত বরফ।
উইস্কনসিনে আসবার আগে আমার
বরফ দেখা সেই আর্কাদি গাইদারের বই-এ। রূপকথার মত বরফশাদা তাইগার জঙ্গল। চুক আর গেক -
মহাদুষ্টু দু’টো মা’র সাথে চলেছে বাবাকে দেখতে। মিনারের মাথায় দিনরাত জ্বলজ্বল
ক’রে লালতারা জ্বলতে থাকা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর মস্কো থেকে তাইগা বহু বহু দূর। তবু
সেখানেই অপেক্ষা করছে বাবা। তারপর বাবার সাথে নতুন বছরে সব বাতি নিভিয়ে ফারগাছের
পাতায় পাতায় সেই সে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া।
ছেলেবেলায় লরা মেরীর বই-এও
বরফ দেখেছি। লরা ইঙ্গেলস্ ওয়াইল্ডারের ‘নদীর তীরে ফুলের মেলা’, ‘রূপালি হ্রদের
তীরে’, ‘এক যে ছিল চাষীর ছেলে’...। মনে পড়ে ‘পা’ খ্রীষ্টমাসে বাড়ি ফিরছে। ‘মা’, লরা, মেরী,
কেরী, প্রাণের কুকুর জ্যাক সবাই অপেক্ষা করছে। এদিকে তুষারঝড়। কোনমতে স্নো
ব্যাঙ্কে নিজেকে সেঁধিয়ে প্রাণ
বাঁচাল ‘পা’। খ্রীষ্টমাসের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল যে তালশাঁসের বিস্কুট তাই খেয়ে।
ছেলেবেলার প্রাণপ্রিয় লরার
জন্ম উইস্কনসিনের পেপিনে। সেই উইস্কনসিনেই যে শেষমেষ আমি পৌঁছে যাব এবং থেকে যাব,
সে আর কে জানত?
এক ঘর থেকে আর এক ঘরে ঘুরে
বেড়াচ্ছি। ঘুরে ফিরে একই কথা বারবার বলবার মত। হাতে রেচেল কারসনের ‘সাইলেন্ট
স্প্রিং’। কতবার যে পড়েছি, তবু আর একবার। বাইরে যতদূর চোখ যায় সব শাদা । উইস্কনসিনের লম্বা
শীতকালে ঘরের ভিতর লেবুফুল ফোটে। ঘরের ভিতর লেবুফুল ফুটেছে। ঘরের ভিতরের লেবুফুলের
গন্ধ আমার শীতকালের বন্দি পৃথিবীটায় একটু যেন জীবনের ভরসা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এখানে তো প্রায় পাঁচ থেকে ছয়মাস শীতকাল। এদিকে গাছের পাতায় হাত না বুলিয়ে আমি তো বাঁচি না বলে, নতুন
পাতার গায়ে নাক গুঁজে নতুন প্রাণের বুনো গন্ধ না শুঁকে আমি তো বাঁচি না বলে শীতকালে কত যে গাছ আমার ঘরের ভিতর। সামারে কেবল ওরা মাঠে
একটু সামার ক্যাম্প করতে যায়। তারপর আবার ঘরে।
‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ পড়ছি। কিভাবে ডিডিটি ঢুকে যাচ্ছে এবং তারপর চিরতরে থেকে যাচ্ছে প্রাণীদের শরীরে, ফুডচেইনে মানুষের শরীরে। ক্যানসারের একটা কারণ,
বংশানুক্রমে শরীরের ভিতরটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার একটা কারণ ডিডিটি । কারসন বলে চলেছেন
ফসলের উপর একবার ডিডিটি দিলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস কিভাবে পোকামাকড়
খুন করতে থাকে এই বিষাক্ত বিষ। যে কীট মারতে চায় কৃষক, শুধু তো তা নয়। মেরে ফেলে আরো
অসংখ্য উপকারী পোকামাকড়। নিজের মরণফাঁদ নিজেই পেতেছে মানুষ। বিষাক্ত
ডিডিটির ধ্বংসযজ্ঞ বৃষ্টির জলেও ধুয়ে যায় না। কারসন উপসংহারে বলেছেন ডিডিটি আর অন্যান্য সব পেস্টিসাইড কি করে
পাখিদের, প্রাণীদের, সারা পৃথিবীর কী অপরিবর্তনীয়, অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, করছে। কারসন বই-এর ‘এ ফেবল ফর টুমরো’
চ্যাপ্টারে লিখেছেন কিভাবে কোন এক শহরে ধীরে ধীরে পাখি, মাছ, আপেল ফুল, ছোট ছোট
শিশু-সকলের ধীরে ধীরে গান গাওয়া, ভেসে বেড়ানো, সৌগন্ধ ছড়ানো, কলকল করে কথা বলা সব
সব বন্ধ হ’য়ে গেল। চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হ’য়ে গেল সবাই।
লেবুফুলের গন্ধ পাই না...। বাইরে তাকাই। বরফ।
আমার বাগানের রঙ শাদা, আমার রংধনুর রং-ও শাদা।
তবু মনে হ’য় কী জানি হয়ত
এমনই ভালো। বসন্ত এসে গেলেই তো শুরু হ’য়ে যাবে প্রতিবেশীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা।
কার লনের ঘাস বেশি সবুজ, কারটা যেন এমারেল্ড বিছানো। শুরু হ’য়ে যাবে ‘উই লাভ গ্রীন’ জাতীয় লনকেয়ার কোম্পানীর রমরমা ব্যবসা।
ঘন্টায় তিরিশ ডলার। বড় সস্তা। ঘাস কাটবে। ঘাসে পেস্টিসাইড ছড়াবে, সোণালি সূর্যের মত ড্যান্ডিলাইন-এর বংশ নির্বংশ ক’রে
ছাড়বে। ওরা আগাছা। ঘাসে কয়েকদিন ধ’রে গোঁজা থাকবে ‘লন কেয়ার এপ্লিকেশন, স্টে অফ্
দা গ্রাস’। কুকুর ঘুরতে পারবে না। বাচ্চারা ঘাসে গড়াগড়ি করতে পারবে না।
ঘাসে শুয়ে ড্যান্ডিলাইন-এর রুপালি তারা ফুঁ দিয়ে দিয়ে বাতাসে ওড়াতে পারবে না।
ম্যানিকিউর, প্যাডিকিউর-এর মত ঘাস কিউর চলছে।
এদিকে আমার তো ড্যান্ডিলাইনকে ঘাসফুল বলে মনে হ’য়। আগাছা কখনোই নয়।
আর এও তো ঠিক ‘Weeds are just misplaced flowers....’ তবে সব আগাছাকেই যে কোলে
তুলে নিতে হ’বে এমন তো নয়। ড্যান্ডিলাইন-এর মত সব আগাছাই ‘বেনেফিসিয়াল উইড’ নয়। বাইরে
থেকে বয়ে আনা কচুরীপানার মত ইনভ্যাসিভ প্ল্যান্ট আমাদের দেশের কী ক্ষতিই না করছে।
এদেশে ইনভ্যাসিভ গারলিক মাস্টার্ড। যেখানে ছড়িয়ে পড়েছে গারলিক মাস্টার্ড, নেটিভ
প্ল্যান্ট সেই জায়গা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। উইড কীলার নয়, হাত দিয়ে একটা একটা ক’রে
গারলিক মাস্টার্ড তোলে এখানকার পরিবেশ সচেতন মানুষ।
![]() |
কোনরকম পেস্টিসাইডহীন ড্যান্ডিলাইনে ভরা আমার লন। |
আগাছার কথায় মনে পড়ল একটা
গল্প। একদিন সকালবেলা। তখন মাত্র নতুন এসেছি এই বাড়িতে। দেখি সামনের বাগান জুড়ে
দেশের থানকুনি পাতার মত পাতা। খুব খুশি হ’লাম। কাজে আসবে। তবে পেটে ভরবার আগে
ভাবলাম এদের বরং সবজি বাগানে ট্রান্সপ্লান্ট ক’রে দেই। একটা বই-এ পড়েছিলাম, গাছ
ট্রান্সপ্লান্ট যদি ভোরবেলা ক’রা হয় তবে গাছটার টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
আমি এলার্ম দিয়ে ভোর সাড়ে চারটায় উঠে পড়লাম। গরমকালে তখন আলো হ’য়ে যায় এখানে। যত্ন
ক’রে থানকুনি পাতাদের সবজি বাগানে ট্রান্সপ্লান্ট ক’রে ফেললাম। কিছুদিন পর আমার
রমরমা থানকুনি পাতার বসতভূমি দেখে পাশের বাড়ির নেইবার বলল, ‘তোমার ভেজিটেবল প্যাচে
তো খুব আগাছা হয়েছে। এরা এত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে! এদের নাম ক্রিপিং চার্লি!’ আজ
পর্যন্ত আমার ভোর সাড়ে চারটার যত্নের কথা তাকে বলি নি। বারো বছর হ’য়ে গেছে। তবে এও তো ঠিক জীবনেও
বেশিরভাগ সময় যত্ন ক’রে আগাছাগুলোই রাখি আমরা! জীবনের যত আগাছা মানুষ, আগাছা সম্পত্তি...
ছেলেবেলার পৃথিবী ভাসিয়ে
নেওয়া বৃষ্টি। ঝমঝম ক’রে বৃষ্টি। চারদিকে বৃষ্টির শব্দ। আমার প্রিয় ভালোবাসার শব্দ। এক একটা ফোঁটা আমার প্রিয় এক একটা ভালোবাসার গল্প...
খুব জোরে ক্যাসেট প্লেয়ার
বাজিয়ে হাত পা নেড়ে তাল দিচ্ছি ‘আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি
নামল...’ মগন গহন শব্দদুটোর পাশাপাশি ব্যবহারে আমি তো একদম বিদ্যুতস্পৃষ্ট। দূরে
ব্যাঙ ডাকছে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ...
একটু গ্রামে থাকি ব’লে আমার
এখনকার পৃথিবীর চারপাশে জলা, ডোবা, ছোট নদী। বাংলাদেশের গ্রামের প্রকৃতি আর
গরমকালে উইস্কনসিনের গ্রামের প্রকৃতির মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য যেন নেই। জলে শাদা
শাপলাও ফুটে থাকে। কিন্তু পাশের জলাটার কাছে গেলে প্রায়ই দেখি বেশ কিছু ব্যাঙাচি । আশেপাশে ব্যাঙ ঘুরে
বেড়াচ্ছে। ব্যাঙগুলো দেখে ‘ক্যানারি
ইন দ্যা কোলমাইন’ কথাটার কথা মনে হ’ল। কয়লার খনিতে ঢুকবার সময় খনি-শ্রমিকরা ক্যানারি পাখি নিয়ে
যেত। নিজেরা খনিতে নামবার আগে বিষাক্ত গ্যাস বিশেষতঃ কার্বন মনোক্সাইডের উপস্থিতি
বোঝবার জন্য সাথে নিয়ে আসা ক্যানারি পাখি এগিয়ে দিত। ক্যানারি ঢলে পড়ত বিষাক্ত
গ্যাস থাকলে। পড়ে দেখলাম একইভাবে ব্যাঙ যেন আমাদের জলের পৃথিবীর ক্যানারি। জলে
ভেসে আসা যে কোন ক্যামিকাল উভচর প্রাণী ব্যাঙের চামড়া খুব সহজেই শুষে নেয়। জীবন
দিয়ে আমাদের জানিয়ে দেয় টক্সিক কেমিক্যাল থেকে প্রকৃতিতে ইকোলজিক্যাল ড্যামেজের
কথা। বার্কলির বিতর্কিত ডঃ টাইরন হেইস-এর আলোচনা পড়ে তো মনটা আরো খারাপ হ’য়ে গেল।
আজকাল অনেক সময় দেখা যায় সরু রোগা পটকা আদি অকৃত্তিম ব্যাঙাচির পাশে বেশ কিছু
মোটাসোটা ব্যাঙাচি। ওই সরু ব্যাঙাচিটা আসল ব্যাঙাচি।
আর তার পাশে নাদুস নুদুস যে
ব্যাঙাচিগুলো সেগুলো আসলে আরটিফিসিয়্যাল হিউম্যান মেল হরমোন আনড্রোজেনের শিকার। ব্যাঙেরা জলে বয়ে আসা এই হরমোন-এর সংস্পর্শে আসলে তা
তাদের থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে গিয়ে আক্রমণ ক’রে। তখন ওরা কোনদিন আর
ব্যাঙ হয় না। এরকম মোটাসোটা ব্যাঙাচি হ’য়েই বাকিটা জীবন থেকে যায়।
ডঃ টাইরন হেইস আরো বলেছেন সিনজেনটা
কোম্পানির হার্বিসাইড আল্ট্রাজাইনের কথা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণা
ক’রে বলেছেন শুধু পশু-পাখি নয়, মানুষেরও বার্থ-ডিফেক্ট হ’তে পারে এই ভয়ংকর
হার্বিসাইড আল্ট্রাজাইন থেকে। অথচ প্রতি বছর শুধু আমেরিকাতেই প্রায় তিনশ’ মিলিয়ন
ডলারের মত বিক্রি হ’য় আল্ট্রাজাইন। ভূট্টা, আখ, ফসলের ক্ষেত, গল্ফ কোর্স, বাড়ির লনে আগাছা
নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার ক’রা হ’য় আল্ট্রাজাইন।
আর সেইসব আল্ট্রাজাইন বিষ
জলে ভেসে ডোবাতে গিয়ে পড়ে, লেকে গিয়ে পড়ে, নদীতে গিয়ে পড়ে।
ডঃ টাইরন হেইস আর তাঁর
সহকর্মীরা বলেছেন পরিবেশে যে মাত্রায় আল্ট্রাজাইন পাওয়া যায়, তাতে ব্যাঙাচিরা
তাদের স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে উভলিঙ্গ প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে। পুরুষ ব্যাঙের শরীরে
স্ত্রী ব্যাঙের অঙ্গ, স্ত্রী ব্যাঙের শরীরে পুরুষ ব্যাঙের অঙ্গ প্রকাশ পাচ্ছে। পুরুষ ব্যাঙদের
গলার স্বর-ও খুব আস্তে হ’য়ে যাচ্ছে। অথচ ওই ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ক’রেই তো ব্যাঙ সঙ্গী
খুঁজে নেয়।
দমবন্ধ হ’য়ে আসতে থাকে...
একসময় আমার স্টউটনে বরফ গলতে
থাকে। গাছের গায়ে ফুলের কুঁড়ির মত পাতার কুঁড়ি। কুঁড়ি
ফুটে পাতা হবে। চারদিকে খড়কুটো জোগাড় করে বাসা বানানোর জন্য পাখিদের মধ্যে হুটোপুটি পড়ে গেছে। একটা রবিন
দেখি উড়ে উড়ে জানালার গায়ে ধাক্কা দিয়ে মাথা কুটে মরছে। সারাদিন ধাই ধাই শব্দ
শুনে ভাবছি মরে যাওয়ার জন্য এত্ত উত্সাহ কেন ওর। পরে জানা গেল ও
জানালার কাঁচে নিজের ছায়া দেখে ভাবছে ওটা আর একটা ছেলে রবিন। মেটিং সিজনে আর কোন
ছেলে পাখিকে ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেবে না ও। বন্ধু হাইডি বুদ্ধি দিল জানালায় লাল উল ঝুলিয়ে দিতে। উল
বাতাসে কেঁপে কেঁপে যাবে। তখন আর সেখানে আর একটা রবিন আছে বলে মনে হ’বে না। কিংবা খবরের কাগজ সেঁটেও দেওয়া যেতে পারে জানালায়।
বাচ্চাদের যে কী যত্ন নেয়
রবিনপাখি। সারাদিন বসে তা দিচ্ছে। ছেলে রবিনপাখি মেয়ে রবিনপাখির জন্য মুখে ক’রে
খাবার নিয়ে আসে। তবে বেশির ভাগ সময় দুপুরের দিকে উঠে একটু কেঁচো খাওয়ার চেষ্টা
ক’রে মেয়ে রবিনপাখি। তখন ডিম পাহাড়া দেয় ছেলে রবিনপাখি। একবার তো দেখলাম, কী ভীষণ
ঝড়। গাছ ভেঙ্গে পড়ছে। বিদ্যুত্। বজ্রপাত বুঝি মাথার উপরই হ’বে। মুষলধারে বৃষ্টি। রবিনপাখির
বাসায় চারটা বাচ্চা। আমার তো পাগল পাগল অবস্থা। কি ক’রে বাঁচাব ওদের? মাথার উপর বড়
একটা কালো ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে থাকব সারারাত? কিন্তু মা’র থেকে মাসীর দরদ? মা রবিন
পাখি আছে না! দুই ডানা পুরোটা মেলে সারাটা রাত ছানা চারটাকে ঢেকে থাকল মা রবিন। আমি
একটু পর পর এসে দেখে যাই। মা পাখির তেলতেলে পাখা থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে, তবু ভিজে
একদম চুব্বুস। অথচ এক ফোঁটা নড়াচড়া নেই। ছানাগুলোর গায়ে পালক গজায় নি। একেবারে
হাড্ডিসার। উইস্কনসিনের বরফ ঠান্ডা বৃষ্টির জল থেকে, এই ভয়ানক ঝড় থেকে ওদের
বাঁচাতে হবে। মা হওয়ার এই শক্তি কোথা থেকে পায় একটা রবিন পাখি?
এই বাড়িতে আমি কত গাছ যে
লাগিয়েছি গত কয়েক বছরে। আমার দুই একর জমিতে গোল্ডেন ডেলিশাস আপেল, গ্রেনী স্মিথ
আপেল, চেরী, প্লাম, পীচ, আঙুরলতা, পীয়ারস, ফ্লাওয়ারিং পীয়ারস্, রেডওক, পিনওক, সুগার
ম্যাপল, সিলভার ম্যাপল, তিন তিনটা রিভার বার্চ। রিভার বার্চ আমার বড় প্রিয়। হালকা
বাদামী আর দারুচিনি মেশানো রঙ। গায়ের বাকল ভূর্জপত্রের মত খুলে খুলে আসছে। হাত
বোলালে পরতে পরতে নরম তুলোট কাগজের মত লাগে। লাগিয়েছি শাদা তারার মত ম্যাগনোলিয়া,
মক অরেঞ্জ, উইপিং উইলো, বেয়াল্লিশটা গোলাপ, কত যে পেরেনিয়াল...। লাগিয়েছি হানিসাকল লতা। টকটকে লাল রঙের ফুল ‘মনার্ডা’। হামিংবার্ড
মধু খাবে। নানারকমের লিলি, কত রকমের যে পিওনি, ফ্লক্স, ফরগেট-মি-নট, নানা ক্লেমাটিস,
ড্যাফোডিল, টিউলিপ, অ্যালিয়াম, কোলুম্বাইন, হোস্তা, ব্লিডিং হার্ট, হাইড্রানজিয়া, রোজ
অফ শ্যারন, এস্টার, মানি-ওয়ার্ট, কোন-ফ্লাওয়ার, ক্রোকাস, হায়াসিন্থ, আইরিস,
স্কুইল, ডেড নেটল্, সুইট উডরাফ্, এস্টিবল্, বেল্-ফ্লাওয়ার, ব্ল্যাক-আইড-সুজান,
বাটারফ্লাই উইড, ক্যাটমিন্ট, কোরালবেল, জেরানিয়াম, ডেলফিনিয়াম, অসট্রিচ ফার্ন, গেফেদার,
গোল্ডেনরড, জো-পাই উইড, ল্যাভেন্ডার, মাম, ওরিয়েন্টাল পপি, পার্পল কোনফ্লাওয়ার,
রাশিয়ান সেজ, স্যালভিয়া, সেডাম, সাস্তা ডেইজী, সলোমনস্ সীল, ভেরোনিকা, ইয়ারো, বাটারফ্লাই
বুশ, ফোরসিথিয়া, লাইলাক...
আর সেই কলরাডো
ব্লু স্প্রুস। যখন গাছটা কিনেছিলাম, মাত্র ফুটখানেক লম্বা ছিল। প্রায় আট ফুট চওড়া, কুড়ি ফুট লম্বা হয়েছে
মাত্র এই কয় বছরে আমার ব্লু স্প্রুস। গাছটার দিকে তাকালেই মনটা এমন গর্বে ভরে ওঠে।
বসন্তে কত পাখি যে বাসা বাঁধে এই গাছে। ফ্ল্যাট সিস্টেম ক’রে ফেলেছে। একতলায় রবিনের বাসা, দোতলায়
ঘুঘু, তিনতলায় হাউস ফিঞ্চ, চারতলায় গ্রেকল।
ঘুঘু পাখির কান্ডকারখানা
দেখে আমি তো অবাক। প্রত্যেক বছর কোন জিপিএস ছাড়া তারা আমার এই ব্লু স্প্রুস গাছে
একই জায়গায় কোথা থেকে ফিরে এসে বাসা বাঁধে। দু দু’টো মুক্তার মত শাদা ডিম পেড়েছে।
বাবা পাখি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ডিমে তা দিচ্ছে। মা পাখি বাকি সময়।
ঘুঘু পাখি যে সাথী খুঁজে নেয় তার সাথে সারা জীবন থাকে। লুন, ম্যান্ডারিন ডাক,
বেশির ভাগ হাঁসদের মধ্যেও এমন দেখা যায়। দেখলাম প্রায় দিন পনেরো লাগল ডিম ফুটে
ছানা বের হ’তে। আর সবচেয়ে আশ্চর্য দেখি মা পাখির বুক থেকে খুব জল জল দুধের মত একটা
লিকুইড বের হচ্ছে। একে বলে ‘ক্রপ মিল্ক’। শুধু মা নয় বাবা পাখিরও এমন ‘ক্রপ মিল্ক’
হ’য়। আর বাচ্চা দু’টোর জীবনের প্রথম তিন চারদিন তাই খাওয়ায় মা বাবা বাচ্চাদের।
তবে গ্রেকলগুলো? ব্লু
স্প্রুসের মাথায় বাসা তো বেঁধেছে। ছানা হয়েছে। এদিকে সারাদিন বাচ্চাগুলোর পুপস্যাক
নিয়ে বাড়ির সুইমিং পুলটায় ফেলে চলেছে। সামারের শুরুতে সাঁতার কাটবার
আগে পুল-এর ধার মহা পরিষ্কার না ক’রে জলে নামা দায়!
আসলে প্রায় শ’খানেক বছর আগে গ্রেকলরা শুধু নদী আর লেকের ধারেই বাসা
বাঁধত। এখন মানুষ নিজেদের সুবিধার জন্য জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করেছে। কিন্তু
গ্রেকলদের রক্তের ভিতর সেই পুরানো অভ্যাস থেকে গেছে। বাচ্চা হ’লে পাখি বাসা খুব
পরিষ্কার রাখে। যেন প্রিডেটরের শিকার না হ’তে হ’য়। যেন কেউ বুঝতে না পারে কোথায়
পাখির বাসাটা। কোথায় বাচ্চারা আছে। শুধু সুইমিং পুল কেন, গ্রেকল ছেড়ে দেয় না সবুজ
গল্ফ্ কোর্সও। মা পাখি, বাবা পাখি মুখে ক’রে বাচ্চাদের পুপস্যাক নিয়ে এসে ফেলে
যায় ওখানেও। গুগলসার্চ দিয়ে পড়ে দেখলাম শ্যাওলা ভরা সবুজ পুকুর বলে মনে
হ’য় নাকি গল্ফ্ কোর্সকে গ্রেকলদের।
এ পর্যন্ত বসন্তে ব্লুবার্ড, রবিন, চিকাডি, হাউজ রেন,ঘুঘু,
হাউস ফিঞ্চ সবাই বাগানে বাসা বেঁধেছে। গত বছর তো গুনে দেখি আমার
লাগানো গাছ আর অন্যান্য নানা গাছ মিলিয়ে প্রায় পঁচিশটা মত পাখির বাসা নানা গাছে।
আমারও তো কাজ ছিল ওই। পা টিপে টিপে সুযোগ পেলেই এ গাছে
ও গাছে উকিঝুঁকি। কোন পাখি বাসা বাঁধল, কোন পাখি ডিম পাড়ল, কোন পাখির ডিম ফুটে
ছানা বের হ’ল – আমার ব্যস্ততাও ওদের থেকে কিছু কম নয়!
দুই কুকুর টংসা, সিম্বার ঘরের উপরে নির্ভয়ে
প্রতি বছর বাসা বেঁধে চলেছে রবিন। প্রতি বছর ওরা ফিরে আসে একই জায়গায়। মোটামুটি
একই সময়ে। মাঝে মাঝে অবশ্য ফিরে আসে বরফ সব গলে না যেতেই। যে যত আগে আসতে পারবে,
তার সুযোগ তত বেশি। অন্যদের আগে সাথী খুঁজে পাবে, অন্যদের আগে এমন জায়গা খুঁজে
পাবে বাসা বাঁধবার জন্য যে নিশ্চিত হবে পরবর্তী প্রজন্মের টিকে থাকা। খাবার দাবারও
পাবে ওরা বেশি, সকলের আগে। তবে কিভাবে পৃথিবীর কোন প্রান্ত থেকে উড়ে উড়ে আমার
বাড়ির ডেকের নীচের এই খোপ ওরা খুঁজে পায়, আমি আজো তা বুঝতে পারি নি। আর প্রাণে কি
ভয়ডর নেই? কুকুরের ঘরের উপর বাসা বেঁধে চলেছে বছরের পর বছর? একবার তো দেখলাম এক
খরগোসও কুকুরের ঘরের পাশে বাসা বাঁধল। অনেক ছানা তুলল, খরগোসদের কাজ যেরকম। হবে
হয়ত আমার প্রাণের টংসা, সিম্বা অনেক ভৌঁ ভৌঁ দেয় ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে চোর এলে লেজ
নেড়ে তাদের পা চেটে দেবে। খরগোস আর পাখিরা ঠিক বুঝে গেছে যে এই দুই কুকুর তাদের
খেয়ে ফেলবে না, বরং দারুণ ভৌঁ ভৌঁ দিয়ে অন্য আর সব শত্রু তাড়াবে। টংসা, সিম্বা
আমার বাগানের পাখি সমাজের ‘রয়্যাল গার্ড’। অবস্থা দেখে সিদ্ধান্তে এলাম পাখির মগজ
নেই সে কথা একদম ঠিক নয়। ওই রবিন পাখি আর বিয়াত্রিক্স পটার–এর এই অতি চালাক পিটার
র্যাবিট খরগোসের মগজ আমার থেকে বেশি।
সেদিন বিকালবেলা বাগানে তিনটা ব্লু-বার্ড
নেস্টবক্স লাগিয়ে এলাম। যত আমি বসন্তের পাখি এই ব্লু-বার্ডদের দেখে আনন্দে
আত্মহারা হ’য়ে যাই, তত সুবিখ্যাত হেনরি ডেভিড থোরো-র কথা মনে হ’য়। ‘ব্লু-বার্ড ক্যারিস দ্যা স্কাই অন হিস ব্যাক’। কিন্তু এই যে ‘পিঠে আকাশ আর পেটের
নীচে সূর্যাস্তের রঙ’ বয়ে বেড়ানো ব্লু-বার্ড, সেও তো উধাও হ’তে চলেছিলো। ব্লু-বার্ড
হচ্ছে সেকেন্ডারী ক্যাভিটি নেস্টার। ওদের ঠোঁট গাছ ঠুকরে ঠুকরে গর্ত করবার মত শক্ত
নয়। ওরা নির্ভর ক’রে কাঠঠোকরার ফেলে যাওয়া বাসার উপর, খোদলের উপর। কিন্তু মানুষ যত
জঙ্গল দখল ক’রে ফেলছে, পেস্টিসাইডে ছেয়ে ফেলছে পৃথিবী, গাছপালা কেটে ফেলছে, অন্য
দেশ থেকে আমদানি করছে বিজাতীয় প্রাণী আর উদ্ভিদ তত কমে যাচ্ছে ব্লু-বার্ডদের বেঁচে
থাকবার সব সুযোগ।
ব্রীডিং বার্ড সারভে থেকে দেখা গেছে
আমেরিকার বহু জায়গা থেকে প্রায় উধাও হ’য়ে গিয়েছিল ব্লু-বার্ড। তবে চাইলে মানুষই
পারে আবার এদের ফিরিয়ে আনতে। ইকোসিস্টেমের ব্যাল্যান্স আনতে। কাঠের তৈরী
নেস্টবক্স ব্লু-বার্ড ট্রেলে দিয়ে আবার ব্লু-বার্ডদের
সংখ্যা অনেকটা বাড়িয়ে তুলেছে তারা।
![]() |
বাড়ির বাগানে আমাদের লাগানো কাঠের ব্লু-বার্ড নেস্টবক্সে ব্লু-বার্ডের ডিম।
এ বসন্তে ট্রি সোয়ালোরা বাসা বাঁধছে বাড়ির কাঠের ফেন্সে
লাগানো হয়েছে যে নেস্টবক্স, সেখানে। আলো পড়লেই রঙ বদলে যায় এমন ঝলমলে গাঢ় নীল পিঠ
আর শাদা বুক ওদের। উড়ন্ত পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। কথায় বলে ট্রি সোয়ালোরা খাবার
খায়, জল খায়, স্নানও ক’রে নাকি উড়তে উড়তে। বাসা বানানোর জন্য যে পাখির পালক জোগাড়
ক’রে তা নিয়েও বাতাসে খেলা ক’রে। একবার ছেড়ে দেয়, তারপর আবার তা মুখে তুলে নেয়।
দেখে দেখে আমার আশ আর মেটে না। আর এরা সবাই বাসা বাঁধছে আমার বাগানে? আনন্দ ধরে
না। কিন্তু প্রায় ৪ সপ্তাহ ধরে বাসা বানাল ওরা। আমার ধৈর্য তো থাকে না। যেন দিনে
একটা ক’রে ঘাস ফেলছে বক্সে ওরা। আসলে খুব সতর্কভাবে আশপাশ দেখেশুনে নিরাপদ একটা
পৃতিবীতেই না আনতে হ’বে বাচ্চাদের। তারপর ডিম পাড়া শুরু হ’তেই ট্রি সোয়ালোরা
কুড়িয়ে আনা পালক দিয়ে ঢেকে দিতে থাকল বাসা ডিম গরম রাখবার জন্য। কি সুন্দর শাদা
পিওনি ফুলের মত যে দেখতে লাগছে সে বাসা তখন। এত্ত সুন্দর ক’রে সাজিয়েছে।
সোনালি-হলুদ উজ্জ্বল
ড্যাফোডিল ফুটতে শুরু করতেই দূরের কোন সে কোন দেশ থেকে ফিরে আসতে থাকল মাইগ্রেটরী
বার্ড সোণালি ‘ওরিয়ল’। মাথাটা কালো। প্রায় সত্তর ফুট উঁচু গাছের উপর পাউচের মত
নেস্ট ক’রে ওরা। কিন্ত বড় মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। বাগানের ড্যাফোডিল ফোটা শুরু
হ’তেই আমি তাই কমলালেবু কেটে ওদের জন্য ঝুলিয়ে দেই। কমলা রঙের মধু দেই। দেই
গ্রেপজেলি। একটু পর পরই ঘুরে ফিরে তা খেতে আসে তারা।
![]() |
ওরিয়ল কমলালেবু খেতে এসেছে |
এবার চারদিকে ফুটে উঠছে
ব্লু হেভেন মর্নিং গ্লোরি। গরমকাল এসে গেছে আমার বরফ ঢাকা পৃথিবীতে।
![]() |
মর্নিং গ্লোরি |
খুব ছেলেবেলায় ভাবতাম যদি
আমার একটা হরিণ থাকত আর তাকে হাত থেকে দানা খেতে দিতে পারতাম। তখন তো আর আমার
মাথায় এত মগজ গজায় নি যে ‘বন্যেরা বনে সুন্দর!’ তখন সব
সুন্দর কিছু দেখলেই পুষে ফেলতে ইচ্ছে করত। নিজের বালিশের পাশে রেখে দেব। ঘুম
ভেঙ্গে মাঝরাতে গায়ে হাত বোলাব। এতদিনে সে আশা পূরণ হ’ল। আরো ভালোভাবে। মুক্ত হরিণ
আমার বাড়ির পিছনের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছানাপোনা সমেত।
তবে এখানে যে হরিণ দেখি
তাদের গায়ে শাদা শাদা ফুটি নেই। এখানে শুধু একদম বাচ্চা হরিণদের গায়ে ফুটি থাকে।
মনে পড়ল খুব ছেলেবেলায় কেউ
একজন ভালোবেসে আমাদের বাড়িতে একটা চিত্রল হরিণের চামড়া উপহার দিয়েছিল। তার বাড়ি
সুন্দরবনের কাছে ছিল। ঘর সাজানোর জন্য, শুধুমাত্র শখের জন্য এভাবে হরিণ মেরে
ফেলাটা যেন খুব স্বাভাবিক। বেআইনি ভাবে তো বটেই। আর একবার যখন মেরে ফেলাই হয়েছে,
তখন তা ব্যবহার না করাটা তো আর এক অপচয়। হরিণের চামড়া তাই আমাদের বসবার ঘরের
দেয়ালে ঝুলে গেল। আমি পাশ দিয়ে যতবার যাই, ততবার চামড়াটায় একটু হাত বুলাই।
ভেলভেটের মত নরম, তুলতুলে। নানা জায়গায় আলো পড়লে ভেলভেটের মতই নানা রকম ছায়া তৈরী
হ’য়। ভেলভেট আমার চিরদিনই এত্ত প্রিয়। ভালোবাসার মত। আর সেই হালকা সোণালি-বাদামি
চামড়ার উপর শাদা শাদা ছোপ ছোপ। আমি পাশে দাঁড়িয়ে যেন দেখতে পেতাম, ঘাড় ঘুরিয়ে
হরিণটা দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় চোখ। ওকে যে কেন মেরে ফেলা হ’ল তা একবারও জিজ্ঞাসা করছে
না। কিন্তু অনেক ছোট ছিলাম বলে আমার খুব কান্না
পেত। আর ছোট ছিলাম ব’লে বাড়ির বড়দের এইসব কথা
কোনদিন বলতে পারিনি।
স্যামন
মাছের জন্ম হয় মিষ্টি জলে। কিন্তু তারপর তারা সমুদ্রে
চলে যায়। সেখানেই তারা সাবালক জীবনটা কাটায়। তারপর ফিরতে শুরু ক’রে নিজ নিজ
জন্মস্থানে। মিষ্টি জলের নদীতে। সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। শুধু সেই নদীতে নয়, অনেক
সময় ফিরে যায় ঠিক ঠিক নিজের ‘স্পনিং গ্রাউন্ডে’। হেরিং মাছও ফিরে যায় জন্মগন্ধ
শুঁকে শুঁকে ডিম পাড়তে নিজের জন্মমাটিতে। স্যামন রানে, হেরিং রানে ঝাঁকে ঝাঁকে
মাছ। সবাই চলেছে। লোভ সামলাবে কিভাবে মানুষ? পেটে ডিম ভর্তি সে মাছ ধরে মানুষ
বেইনীভাবে। এ মাছের স্বাদ এমনকিছু ভালো নয়, পেটের ডিমও পুরোপুরি পোক্ত হয়নি তখনো।
তাতেও স্বাদ নেই। তবু। তাছাড়াও মানুষ নিজেদের সুবিধার জন্য নদীর বুকে বাঁধ দিয়েছে।
সে বাঁধ পড়েছে স্যামনের ঘরে ফিরবার পথে, হেরিং-এর ঘরে ফিরবার পথে। কখনো কখনো কোন
কোন ড্যামে ‘ফিস প্যাসেজ’ ক’রে দেওয়া হয়েছে যেন মাছ বাঁধে পথ খুঁজে যেতে পারে।
কিন্তু পড়ে দেখলাম কলাম্বিয়া নদীর অববাহিকায় ৫৫% এর বেশি স্যামন রানের পথ বাঁধ
দিয়ে চিরদিনের জন্য বন্ধ ক’রে দিয়েছে মানুষ। এমন আরো কত। হেরিং মাছ, স্যামন মাছ বাঁধে মাথা কুটে মরবে। ডিম
পাড়বার জন্য জন্মের জায়গায় ফিরতে পারবে না।
আর সীল ক্লাবিং? মানুষ কত নিষ্ঠুর হ’তে পারে! নরওয়ে, কানাডা, নামিবিয়া, গ্রীনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইডেন – এইসব দেশে কোন কারণ ছাড়া বাচ্চা সীল
মেরে ফেলা একটা স্পোর্টের মধ্যে পড়ে। অসহায় বাচ্চা সীলগুলি শিকার হয় শিকারীদের।
লম্বা লাঠির মাথায় হাতুড়ির মত(হাকাপিক), তা দিয়ে এক কোপে ওরা প্রাণ নেয় বাচ্চা সীলমাছের। এই নিয়েই প্রতিযোগিতা। কে কতগুলো
বাচ্চাকে মেরে ফেলতে পারল। শুধুমাত্র এক নৃশংস আনন্দ পাওয়ার জন্যই ওদের মেরে ফেলে
মানুষ। মাঝে মাঝে ভাবি শুধু মানুষই বুঝি এমন করতে পারে। নিছক আনন্দ পাবার জন্য
হত্যা। বনের বাঘও শিকার ক’রে। খাবারের জন্য, বেঁচে থাকবার জন্য।
মানুষের
মেরে ফেলা সীলের ফার দিয়ে তৈরী হ’য় কোট, টুপি, পা ফেলবার, পা রাখবার কার্পেট। হয় হার্প সী ওয়েল – যেখানে আছে ওমেগা
থ্রী ফ্যাটি এসিড।
মনে
পড়ে কিপলিং-এর ‘হোয়াইট সীল’-এর কথা? সীলের চোখ থেকে দেখা সেই গল্প? দুর্লভ,
তুলতুলে শাদা ফারের সীল ‘কটিক’ তার দলের অন্যান্য সীলের জন্য ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে,
স্বর্গ খুঁজে বেড়াচ্ছে। যেখানে
কোন মানুষ ওদের আর শিকার
করতে পারবে না। যতবার এ গল্প পড়ি, চোখের জল ধরে রাখা কঠিন হয়।
কতকিছুর জন্য বেআইনীভাবে বাঘ
মারা হ’য়। টনিক, কিউরিও...।
তবে সেদিন রয়টারের খবরে জানলাম চোরাচালানীদের মাধ্যমে বাংলাদেশের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের
দু’টো বাচ্চার এক একটা নাকি প্রায়
পঁচিশ হাজার ডলারে বিক্রি হতে গিয়ে ধরা
পড়েছে। পোচাররা এতদিন বাঘ
মেরে তার দাঁত, নখ পাচার করছিলো। এবার আস্ত বাঘের বাচ্চা!
ট্র্যাডিশনাল এশিয়ান ওষুধের
জন্য বাঘের শরীরের নানা অংশ নাকি কাজে লাগে। এইসব ওষুধের আছে নাকি যাদুকরী শক্তি।
বাঘের পিত্ত বাচ্চাদের খিচুনী সারাতে? বাঘের রক্ত স্বাস্থ্য আর ইচ্ছাশক্তি বাড়াতে?
বাঘের ঘিলু ব্রন আর আলস্য কমাতে? বাঘের নখ গুড লাক চার্ম গয়নাগাটি বানাতে? বাঘের
গোঁফ নাকি দাঁতের ব্যথা, বাঘের হাড় মানুষের কঠিন হাড়ের ওষুধ দূর করতে কাজে আসে। পড়তে
পড়তে দুঃখে হাসি পায়।
টাইগার বাম? কপালে ঘষে
মানুষের সব তুচ্ছ মাথাব্যথা সত্যিই বুঝি সেরে যাবে? এখনও
কিছু করতে পারলে ভালো। নয়ত
বাকি জীবন হাতুড়ে ডাক্তারির চাইনীজ ওষুধ বাঘ মেরেই হবে।
লেদারব্যাক টারটল্ ভেসে
বেড়াচ্ছে মহাসমুদ্রে। ওদের প্রধান খাবার জেলিমাছ। কিন্তু পরিবেশ দূষণ ছেড়ে দেয়নি
ওদেরও। সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে শাদা শাদা প্লাস্টিক গারবেজ। জেলিফিশ ভেবে
লেদারব্যাক টারটল্ ভুল ক’রে তাই খেয়ে ফেলছে আর তারপর প্লাস্টিক হজম না করতে পেরে মারা
যাচ্ছে।
সারা পৃথিবীতে প্রায় আট
প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ আছে যাদের অস্ত্বিত্ব এখন বিপন্ন। কচ্ছপের মাংস, কচ্ছপের চামড়ার ব্যাগ এখনো লোভনীয়।
সতর্ক না হ’লে ওরা যে কোন
সময়ই চলে যাবে বিলুপ্তির পথে।
সত্যি কত কী যে মানুষের
প্রয়োজন! হাতির দাঁত, হাতির হাড়, সাপের চামড়া, প্রাণী মেরে তার শরীরের সব অংশ। বন
কেটে কেটে পশু পাখির সব বসতির জায়গা দখল।
গতবার ডিজনী গেছি। জাপানি
প্যাভিলিয়নে শুনি তালে তালে ড্রাম বাজানোর শব্দ। আমি ভাবলাম কী জানি কোন নাচ হচ্ছে
হয়ত। উঁকিঝুকি দিয়ে তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে দেখি টেবিলের উপর সাগরতীর মত করে জল। তাতে
অনেক অয়েস্টার ভাসছে। এত সুন্দর দেখতে। কিন্তু গল্প সেটা নয়। লাইন দিয়ে বাচ্চা, বড়
সবাই দাঁড়িয়ে আছে। অয়েস্টার পছন্দ করছে। তারপর জাপানি পোশাক পড়া মেয়েদের হাতে দিলে
তারা ধারালো ছুড়ি দিয়ে জ্যান্ত অয়েস্টারের বুকটা চিরে মুক্তা বের ক’রে ক্রেতার
হাতে দিচ্ছে। অয়েস্টা্রটা গারবেজ বিনে ফেলে দিচ্ছে। আর যখন মুক্তাটা বের করছে,
তালে তালে ড্রাম আরো জোরে জোরে বেজে উঠছে। এটাই বিজনেস্। হয়ত খুব স্বাভাবিক মনে
হচ্ছে সবার। কিন্তু আমার এত বেশি খারাপ লাগল। শুধু মনে হ’ল সেই প্রাগৈতিহাসিক দিন
থেকে প্রাণী শিকারের সাথে, প্রাণী হত্যা করবার সাথে মানুষের এই পৈশাচিক আনন্দ, এই
ঢোলের বাজনা কমেনি। কোনদিন কমবেও না।
একদিন বাড়ি এসে বললাম একটা
পোলার বীয়ার এডপ্ট করেছি। তার ছবি পাঠিয়েছে। আর নানা তথ্য। হৈ, তাথৈ খুব খুশি হ’ল।
তারপর কেউ যখন আশেপাশে নেই, তাথৈ চুপিচুপি এসে আমাকে বলল,‘মাম্, ও আমার ঘরে
ঘুমাবে না তো?’ আমি তো হেসে অস্থির। পোলার বীয়ার স্টাফড্ টয় খুব ভালোবাসলেও মনে
হয় সত্যিকারের পোলার বীয়ারের সাথে ঘর শেয়ার করতে একটু ভয় পেয়েছে। বললাম, ‘না, না,
এটা মূলতঃ ডোনেশন দেওয়া ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডকে যেন তারা এনডেনজারড
স্পিশিসদের কন্জারভেশন করতে পারে। পোলার বীয়ারের পায়ের নীচ থেকে আর্কটিক সমুদ্রের
যে বরফ গলে যাচ্ছে, যে বরফ সরে যাচ্ছে – তার জন্য সামান্য হলেও যদি কিছু করতে পারে
মানুষ!
কিন্তু এমনি ক’রে মুষ্টিমেয়
কয়টা প্রাণীর কথা ভাবতে পারব আমরা? কয়টা প্রাণীকে সিম্বলিকভাবে এডপ্ট করব? মানুষের
লোভ মানুষের হাতের মুঠো ছাড়িয়ে গেছে। উপচে পড়ছে চাওয়া, উপচে পড়ছে পাওয়া। অথচ এর
কিছুরই তার দরকার নেই।
পাতার শব্দ নয়। বরফের শব্দ
নয়। বৃষ্টির শব্দ নয়। এবার ঝড়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এ ঝড় অন্যরকম ঝড়।
সব প্রাণী দ্রুত দৌঁড়ে ছুটে
যাচ্ছে। খুরের শব্দ তুলে। পাখার শব্দ তুলে। লেজের ঝাপট দিয়ে। ওরা মানুষের কাছ থেকে
পালিয়ে যাচ্ছে। এই পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছে। মাথায় মুকুট পরে রাজাধিরাজ মানুষ, লোভী
মানুষ শুধু দাঁড়িয়ে আছে। একা। অন্য কোন প্রাণীহীন। দাঁড়িয়ে আছে নিজের হাতে তৈরী নিজের
মৃত্যু-গুহায়।
[রেচেল কারসনের জন্মদিনে
২৭ শে মে, ২০১৪]
গ্রন্থ ও রচনার তালিকাঃ
সাইলেন্ট স্প্রিং - রেচেল কারসন
ওয়ালডেন – হেনরি ডেভিড থোরো
দ্যা হোয়াইট সীল - কিপলিং
http://sciblogs.co.nz/chthonic-wildlife-ramblings/2009/09/22/why-do-tigers-get-poached/
চমৎকার লাগলো। এত তথ্যসমৃদ্ধ, অথচ মরমী গদ্য খুব কমই পড়েছি।
উত্তরমুছুন