আঁকা - কল্যাণী রমা

'ফ্ল্যাক্স-সীড’ লুচি

- কল্যাণী রমা
কোন ধরণের রাঁধুনি না হয়েও গত কিছুদিন ধরে নানা রকমের রান্নাবান্না নিয়ে লিখে ফেলেছি আমি। প্রচুর ‘লাইক’ এবং ‘লাভ’ রিয়াকশন ফেসবুকে । কিছুদিন আগেই তো। আমার তামিল, আইয়্যার ব্রাহ্মণ প্রাণের বন্ধু ভিজি নারায়নন ফেসবুকে আমার রন্ধনশৈলীর দারুণ উৎপাত দেখে ভালোবেসে তো বলেই ফেলল, “ইউ আর এ গ্রেট শেফ, কাজু!” বেচারা বোঝেনি ওগুলো মাছের চপ ছিল!

আমি আসলে রান্নাবান্না করি প্রধানতঃ লোকজনকে নিমন্ত্রণ করলে কিংবা ফেসবুকে রান্নার ছবি আপলোড করবার থাকলে। প্রতিদিনের ডাল, চচ্চড়ি রাঁধায় আমার বড়ই অভক্তি। মঞ্চে যেসব শিল্পী গান করেন তারা কি ঘুম থেকে উঠেই বেসুরে বাথরুমে সুর ভাজেন? ওইসব গড়ের মাঠ আনাড়িদের জন্য খোলা। তবে এত এত প্রশংসা সামলানোও বড় মুশকিল। সকলের মন জয় করে যুতসই এক একটা উত্তর তো দিতে হবে? শুধু নিজের বন্ধুদের নয়। বন্ধুদের বন্ধুদেরও। তারা হয়ত অনেক কষ্ট করে ফেসবুকে কাউকে মুগ্ধ করছিল । আমার বেফাঁস উত্তরে তাদের মাঝবয়সের প্রেম ভেঙে না যায়!

“ফেসবুকের বন্ধু” – এ আজকাল বন্ধুত্বের এক নতুন মাত্রা । এবার দেশ থেকে যখন ফিরলাম, প্রিয় বন্ধু সুস্মিকে দেখাচ্ছি দেশের ছবি। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের মাঝে মধ্যমণি হ’য়ে আমি। আমার ক্লাশ টু থেকে বন্ধু সুস্মি আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনকে আমার থেকেও ভালো চেনে। অথচ ও বলল, ‘এরা কারা?’ ‘কেন, আমার ফেসবুকের বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন’! এদিকে বাড়ির লোকজনও খুব স্মার্ট হয়ে গেছে, যুগের হাওয়াটা ধরতে পেরেছে। কিভাবে বন্ধুত্ব, কোথায় পরিচয় একেবারেই জিজ্ঞাসা না করে সকলকে তারা দুপুরে, রাতে ফার্মের মুরগির ঝোল-ভাত খাইয়ে দিয়েছে। সাথে লেবুর আচার। তবু ব্যাকডেটেড সুস্মিটা শুধু বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে বলে উঠল, ‘সামনের বছর ইলেকশনে দাঁড়াস’!

আজ বাইরে রোদ নেই। উইস্কনসিনে শীতকালে বেশিরভাগ সময়ই থাকে না। ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু’র গ্রেট কোট পরা আকাশ। কিন্তু আজ গত শনিবার দুপুরের কথা লিখব। সেদিন-
‘অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল,
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল,
মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিল অনেক;
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল;
অনেক কমলা রঙের রোদ;
আর তুমি ছিলে;’
নাহ্‌, ফুলস্টপ, ব্রেক, দাড়ি, কমা সব । একেবারেই এরপর নিজের গন্ধ, স্পর্শহীন জীবনের হাহাকার নয় আর ।
মনে আছে কুমার শানু লুক এলাইকের কথা? এক কদম, এক কদম ফেলে মঞ্চে উঠছেন । দু’ হাত ‘তালি থামান, তালি থামান’ ভঙ্গিতে আকাশে তোলা। অথচ কেউ কিন্তু তালি দিচ্ছে না। বরং কিছুটা বিরক্তই। একইভাবে আমিও মঞ্চে উঠে আসছি। ‘ফ্ল্যাক্স-সীড’ লুচির গল্প বলব।

আমাদের কুকুর ‘পপি’ উদাস নয়নে জানালা দিয়ে বাইরের রোদ দেখছে। আর আমি ছুটির দিন শনিবারে দুপুরের খাওয়ার টেবিল ফ্ল্যাক্স-সীড লুচি, আলুর দমে ভরে দিচ্ছি। ময়দার সাথে খানিকটা আটা মিশিয়েছি। ঘি নয়, লুচি তেলে ভেজেছি। মাঝে মাঝে ভালোবাসা তো উথলে উঠেই। নিয়ম ভেঙে বাইরের লোকজনকে নিমন্ত্রণ না করেও শুধু ঘরের মানুষজনদের জন্য রান্না করতে, চূলার পাশে তখন অ্যালু ভেরা নিয়ে চলে যাই। টবে অ্যালু ভেরা লাগিয়েছি আমি। ছ্যাকা খেলেই অ্যালু ভেরার রস ডলে দেই চামড়ায়। আহা রে সত্যিকারের জীবনেও যদি অ্যালু ভেরা থাকত কোন। পুড়ে গিয়ে বেদনায় মলম লাগানো যেত।

আসলে এটা আমাদের আবিষ্কার। লুচিতে ফ্ল্যাক্স-সীড দিলে লুচি ফোলে ভালো। স্বাস্থ্যর জন্যও উপকারী। ফ্ল্যাক্স-সীড ব্লাড প্রেসার কমায়। ব্লাড সুগারের লেভেল কমায় । মনের অসুখের কোন প্রিকশন নেই পৃথিবীতে, ভুড়ি কমানোর অনেক প্রিকশন আছে, শরীরে অসুখ যেন না হ’য় তার প্রিকশন আছে। ঘুম ভেঙে উঠেই চিরতার জল খাওয়া আছে।

লুচির ময়দায় অল্প লেবু চিপে দিলেও লুচি ফুলে ওঠে। জীবনটাকে পূর্ণতায় ফুলিয়ে তুলতে হ’লে অল্পস্বল্প অম্লতা তো চাই-ই চাই। বিশ্বাস না হয় করে দেখ। না হলে জানিও। লিখে জানাতে হবে কিন্তু। ‘অসির চেয়ে মসী বড়।’
একটি মেয়ে। বাচ্চা হবে। বরের সাথে গ্রোসারি করতে গেছে। মা হওয়ার সময় কত কিছুই তো খেতে ইচ্ছে করে। ফুলকো লুচি; কিসমিস্ দেওয়া তবুও ঝাল ঝাল আলুর দম; বড়ই- এর আচার; কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা দিয়ে চালতা মাখা; মচমচ ক’রে টোস্ট বিস্কুট...মেয়েটি বলল, ‘এই যে শোনো, খুব আনারস খেতে ইচ্ছে করছে।’ পয়সার কোনই অভাব নেই ওদের। চার চারটা গাড়ি। ছয় হাজার স্কয়ার ফুটের বাড়ি। তবু বরটি বলল, ‘আনারসের খুব দাম।’

আর একটি ছেলে ছিল। বিয়ের পঁচিশ বছর কেটে গেছে। ওরা আলাদা ঘরেই ঘুমায় গত কুড়ি বছর ধরে। অথচ কথা তো ছিলই কোনদিন তৃষ্ণা মিটবে না ওদের? একসাথে পড়বে কবিতা,
“জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার—
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার...
সোনালি-সোনালি চিল— শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে—
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!”
আসলে বিয়ের পর পাঁচটা বছর বিয়েটা ঠিকই ছিল।
“বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখে নি কোনো খাদ,
সময়ের উর্দ্ধতনে উঠে এসে বধূ
মধু – আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;”
কিন্তু পাঁচটি বছর কেটে যেতেই একা একা শুধু দড়িতে কাপড় শুকানো আর বাজারের থলি হাতে মাছ কিনতে যাওয়া!

অবশ্য তা সে দু’জন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ নাক ডাকাডাকির অজুহাত দেখিয়ে যদি আলাদা আলাদা ঘরে ঘুমায়, তা নিয়ে বলবার তো কিছু নেই। কিন্তু যখন তারা কুড়িটা বছর ধরে দুপুরে বা রাতে একসাথে খেতে বসে না, তখন সে গল্প আমার বুকে বড় বাজে। দু’জন মানুষ কষ্ট ক’রে একসাথে রাঁধবে, তারপর দু’জন দু’জনের রান্নার প্রশংসা করতে করতে একসাথে খাবে, এই তো মমতার ছবি! প্রস্তর যুগেও তো মানুষ দিনের শেষে একসাথে বসে খেত! মানুষ অদ্ভুত প্রাণী। তার ভালোবাসা সমুদ্রে শুকিয়ে যায়, খানা খন্দে বেঁচে থাকে। তাই এই বউটিও আবার কিন্তু নিজের চব্বিশ বছরের মেয়েকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়!

ডিজনিতে গেছে একটি পরিবার সাত সাতবার। তবু তাদের বউটি পিছনে পিছনে টুক টুক ক’রে একা একা এগিয়ে চলে। বরটি সামনে সামনে বিশ্বজয়ে।
‘আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে, গেছে বেঁকে...
সাথিহারার গোপন ব্যথা বলব যারে সেজন কোথা--
পথিকরা যায় আপন-মনে, আমারে যায় পিছু রেখে॥'

আমাদের কুকুর পপি হচ্ছে বর্ডার কলি পাপ। ছয় মাস বয়স। পৃথিবীর সবচেয়ে দৌড়বাজ কুকুরদের মধ্যে একজন হচ্ছে বর্ডার কলি ব্রীড। তবে বর্ডার কলি পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান কুকুরও বটে! তাই যখন রাস্তায় ওর সাথে হাঁটতে বের হই; ও এক পা যায়, দু’ পা আমার জন্য থামে। ও কখনো আমাকে ফেলে সামনে চলে যায় না। যাবে কেন? আমরা তো একসাথে বের হয়েছি। পপি এক ঘরে আর আমি অন্য ঘরে হয়ত আছি। ও করিডোরের ফাঁক দিয়ে, দরজার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে মুখ করে রাখে। প্রতি মুহুর্তে যেন ও আমায় ‘চোখে না হারায়’।

এ লেখাটা লিখছি ফুড পোর্টালের জন্য। সেখানে যদিও জানি না কেন শুধু খাবার দাবারের ছবি ছাপে। অসীম শক্তিধর এডমিনরা কিছু খেয়ে মানুষের মুখের তৃপ্তির হাসিটুকু কেটে দেয় – মানুষের কোন ছবি ছাপে না ওরা। কী জানি তারা আমার উদাসী পপির ছবিও কেটে দেবে কিনা! কিন্তু কোন এক শনিবারের ছুটির দুপুরে ছোট্ট এক কুকুরছানা জানালা দিয়ে বাইরের রোদ দেখছে আর খাওয়ার টেবিলের শূন্য বাটি লুচিতে ভরে যাচ্ছে – এর চেয়ে ভালোবাসার ছবি আর কী হতে পারে? তা হোকই না কেন সে স্বাস্থ্যকর ফ্ল্যাক্স-সীড লুচি!

ডগ-ফুড খেয়েও খুব মনুষত্ব হয়েছে আমাদের পপির। ও পথ চেয়ে বসে থাকতে শিখেছে। ও অপেক্ষা ক'রে ! যখনই কিছু খাই পলক না ফেলে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। 'রান্নাটা কেমন হয়েছে?’


উদাসী পপি


শূন্য বাটি


ফুলকো লুচি


শূন্য প্লেট ভরে যাচ্ছে লুচিতে


আলুর দম

মন্তব্যসমূহ

  1. বলা ভালো এককথায়,প্রথম লাইনের পর সেই যে নিঃশ্বাস টেনাছিলাম ফেল্লাম শেষ লাইনের পর।
    এই হল কথা।আর কী বা বলার আছে।
    মনের কথা একজন গদ্যকার যখন লিখে দেন তার মানে কী দাঁড়ায়,তিনি সার্থক।
    অনেক ভালোবাসা

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন



কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বইঃ
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।