আঁকা - কল্যাণী রমা

লবঙ্গ, এলাচ, দারচিনি (১)

পুঁটিমাছের চ্যাপা শুঁটকি
-------------------------------
আমার দিদার বাড়ি সরিষাবাড়ী। ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর জেলায়। দিদার মা'র যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স চার। দিদার বাবার বয়স সাত। পরে যখন ওঁরা বড় হল দিদার বাবার উচ্চতা হল ছয় ফুট আর মা'র উচ্চতা চার ফুট। মনে হয় ওঁদের ভালোবাসা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নামত। দিদার মা'র শ্যামলা গায়ের রং , পা পর্যন্ত চুল। আর দিদার বাবা নাকি সাহেবদের মত দেখতে। খুব ফর্সা রং। মা'রা সবাই তাকে মিষ্টি দাদু বলে ডাকত। তিনি ছিলেন সে এলাকার প্রথম এম বি বি এস ডাক্তার। সেকথা আমার দিদার থেকে গর্ব ভরে আমার দাদুই অবশ্য বেশি বলতো। 'বুঝলি তো তোর দিদা হচ্ছে সম্ভ্ৰান্ত ঘরের মেয়ে। তার বাবা হচ্ছে ডাক্তার আর আমি হ'লাম গ্রামের ছেলে । আমরা চ্যাপা শুঁটকি খাই আর তোর দিদা নাকে কাপড় চাপা দেয়।'
হ্যাঁ , পুড্ডা হচ্ছে আমার দাদুভাই-এর গ্রামের নাম। ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজিলায় সেই গ্রাম। আমি কয়েকবার গেছি। পুকুরপাড়ে বড় মঠ, স্টেশন থেকে তার চূড়া দেখা যায়। মঠের গায়ে ছোট ছোট রঙিন কাচ গেঁথে নানা নকশা করা। এখানে দাদুভাই এর বাড়ির সকলের দাহ করা হয়েছে। দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত দেখে মনে হত আমাদের প্রতিদিনের দৌড়াদৌড়ি করে বছরের পর বছর তেলাপোকার মত টিকে থাকবার চেয়ে এই ধানক্ষেতের আলে চুপচাপ বসে থাকাও অনেক ভালো।
কথায় কথায় কোথায় চলে এলাম। পুড্ডা গ্রাম নয়, সরিষাবাড়ী নয় আজকের এই সকালে আমি আসলে যেতে চেয়েছিলাম নিকলি গ্রামে। আমার দাদুর মামাবাড়ি। নিকলি হচ্ছে হাওর এলাকা। হাওর শব্দটা বুঝি সাগর থেকে এসেছে। বর্ষাকালে গেলে দেখা যায় চারদিকে শুধু জল আর জল । এক বাড়ি থেকে আর এক বাড়িতে প্রায়ই ডিঙি নৌকা করে যেতে হয়। হেঁটে যাওয়ার পথ থাকে না।
শেষ যেবার গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখি উঠানে অনেকগুলো ড্রাম এনে রাখা হয়েছে। সেই ড্রাম ভর্তি মাছ। আমি জীবনে কোনোদিন এতো মাছ একসাথে দেখি নি। ওরা মোটা চালের ভাতের সাথে উঁচু করে পুঁটিমাছ ভাজা দিল । ভাতটা মেখে খেতে হয় মাছের পেটের তেল দিয়ে । বাটা মাছ, ট্যাঙরা মাছ, কেঁচকি মাছ, পাবদা মাছ। এমনও হয় নিকলিতে যে অন্য খাবার হয়ত নেই, কিন্তু মাছ আছে। খেয়ে শেষ করা যায় না তা , তখন করা হয় শুঁটকি। আমরাও খেলাম পুঁটি মাছের চ্যাপা শুঁটকি। যত শুঁটকি খেয়েছি এই জীবনে , সবচেয়ে ভালো লেগেছে আমার এই চ্যাপা শুঁটকি। টকটকে লাল রং, অনেক রসুন দেয়া, অসংখ্য কাঁচা মরিচ উঁকি দিচ্ছে - অসম্ভব ঝাল। শুধুই মাছ, কোন সবজি নেই তাতে - একেই বলে চাঁছনি। জিভ থেকে জল পড়তে শুরু ক'রে আমার সেকথা ভাবলেই ।
দিদা তার চুরানব্বই বছরের জীবনে কোনোদিন শুঁটকি খায় নি। কিন্তু আমাদের রাজশাহী বাসায় প্রায়ই রান্না হ'ত চ্যাপা শুঁটকি। কোন রকম টেস্ট না করেই দিদা বাড়ির সকলের জন্য, বিশেষত: দাদুভাই-এর জন্য শুঁটকি রান্না করত দরজা জানালা খুলে - কোন রকম প্রশংসার আশা না করে , সংসারের কাছ থেকে নোবেল প্রাইজ আশা না করে। । দাদুভাই ঠাট্টা ক'রে বলত, 'ওই দেখ, তোর দিদা নাকে কাপড় চাপা দিয়ে আবার দুর্গন্ধ রাঁধছে।' আমি ভাবতাম গরম দেশ বলে দরজা, জানালা খুলে এমন শুঁটকি রাঁধা যাচ্ছে। কিন্তু শুঁটকি খেতে ইচ্ছে করলে আমার এই শীতের দেশে আমি কি করব? এদেশে আমিও শুঁটকি রেঁধেছি। কোন ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার আগে।
শেষ যেবার দেশ থেকে ফিরি , ভোর চারটায় বাড়ির সবাই উঠেছে। অমন পাগলপারা অসময়েই আমেরিকার ফ্লাইট। মা বলল, ' ফ্রীজে একটু চ্যাপা শুঁটকি আছে, খাবি?' এসব প্রশ্ন কেউ আবার মানুষকে করে? আমি চারটার সময় চাঁছনির মরিচ ডলে শুঁটকি দিয়ে ভাত মেখে ফেললাম। শুঁটকির ঝালের জন্য নাকি বাড়ির সকলকে ছেড়ে আসব বলে জানিনা - আমার চোখ থেকে ঝর ঝর করে জল ঝরতে থাকলো।

পুঁটিমাছের চ্যাপা শুঁটকি

মন্তব্যসমূহ



কল্যাণী রমা-র জন্ম ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ভারতের খড়গপুর আই আই টি থেকে ইলেকট্রনিক্স এ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল কমুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং-এ বি টেক করেছেন । এখন আমেরিকার উইস্কনসিনে থাকেন। অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সিনিয়র ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে কাজ করছেন ম্যাডিসনে।
প্রকাশিত বইঃ
আমার ঘরোয়া গল্প;
হাতের পাতায় গল্পগুলো – ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা;
রাত বৃষ্টি বুনোহাঁস – অ্যান সেক্সটন, সিলভিয়া প্লাথ, মেরি অলিভারের কবিতা;
মরণ হ’তে জাগি – হেনরিক ইবসেনের নাটক;
রেশমগুটি;
জলরঙ;
দমবন্ধ।