আমার ঘরোয়া গল্পঃসাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতা
~কল্যাণী রমা
‘এখানে তুমি সংখ্যালঘু
‘এখানে তুমি সংখ্যালঘু
ওখানে তুমি জমজমাট
এখানে তুমি বস্তিবাসী
ওখানে চষো রাস্তাঘাট
এখানে তুমি ভয় পেয়েছ
এখানে তুমি নিঃসহায়
এখানে তুমি নামহারানো
ওখানে প্রিয় কামাল ভাই
কোথায় যেন মানুষ কাঁদে
কোথায় যেন কাঁদছে হায়
মানুষ বড় ভয় পেয়েছে
মানুষ বড় নিঃসহায়
ওখানে তুমি সংখ্যালঘু
এখানে তুমি জমজমাট
ওখানে তুমি বস্তিবাসী
এখানে চষো রাস্তাঘাট
ওখানে তুমি ভয় পেয়েছ
ওখানে তুমি নিঃসহায়
ওখানে তুমি নামহারানো
এখানে চেনা কমল রায়।’
-মৌসুমী ভৌমিক(“সংখ্যালঘু”)
রূপকথা
কোনদিন কোন বিতর্কসভায়
সুবক্তা ছিলাম না। কোন কথায় যুক্তি নেই, প্রতিযুক্তি আরো
দূর অস্ত। যে কোন গুরুগম্ভীর বিষয় দেখলে দারুণ ভয় পাই। কমা, দাড়ি,
সেমিকোলন, বানানের ঘেরাটোপ এড়িয়ে আসল বিষয়ে
পৌঁছানোর আগেই হুমড়ি খেয়ে পড়ি। এটি পুরোপুরি আমার অপারগতা। অকপটে স্বীকার করছি।
মস্তিষ্কের চেয়ে চিরকাল আগে আগে হেঁটে চলে হৃত্পিন্ড। কি আর ক’রা যাবে? এভাবেই জীবনের অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি চোখের
জল নির্ভর জাতি হিসাবে। এমন একটা দৃঢ় সিদ্ধান্তেও পৌঁছে গেছি যে কোনদিন কোন বিষয়ে
আমার দ্বারা আর প্রবন্ধ লেখা হ’বে না।
তবে আমি যেভাবে পারি, যা পারি, নানা বিষয়ে নাহয় দু’ চারটি
এলোমেলো ঘরোয়া গল্পই বলি। চা দিতে দিতে মানুষ যেমন বলে থাকে আর কি। রক্তের ভিতর
মিশে থাকা অস্তিত্বের গল্প।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান জুড়ে আজ দেখি সাম্প্রদায়িকতা,
অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম, অধর্ম
এইসব নিয়ে অনেক, অনেক আলোচনা। অসাধারণ দক্ষতায় লেখকরা তুলে
ধরছেন নানা তথ্য। করছেন বিষয়গুলোর সূক্ষ্ণ, চুলচেরা
বিশ্লেষণ। অথচ এই শব্দগুলো শুনলে আমার চোখের সামনে শুধু ভেসে ওঠে ছেলেবেলার কিছু,
কিছু ছবি, কিছু ছোট কথা এবং গল্প...
ছেলেবেলা কেটেছে বাংলাদেশে, এক সত্যিকারের রূপকথার মত পরিবেশে। আমার সব মুসলিম বন্ধু বেহেশত্ কিংবা
স্বর্গ থেকে নেমেছিলো কিনা জানিনা। কিন্তু ওরা ছিল সত্যিই ‘দেবদূত’
শব্দের সংজ্ঞা।
আমাদের বাড়িতে খুব বেশি
কিছু হিন্দু পূজা এবং অনুষ্ঠান হ’ত না। হ’ত সরস্বতী পূজা।আমরা দুই বোন বাদে আর যত ছোট বাচ্চারা আমাদের বাড়িতে পূজায় আসতো
তারা সবাই মুসলিম ছিলো। ওরা অঞ্জলি দিত না। কিন্তু মুগডাল দেওয়া পূজার খিচুড়ি (যা
সারা বছরে আর কখনো রাঁধলে কোনদিনই সেই স্বাদ হ’ত না);
বাজারে নতুন ওঠা মটরশুঁটি দিয়ে, আলু দিয়ে
রাঁধা বাঁধাকপির তরকারি; প্রায় তেলে ভাসা ভাসা, ভাজা ভাজা ফুলকপি (লিখতে গিয়ে সত্যিই আমার জিভে জল এসে যাচ্ছে); বেগুন ভাজা; দিদার বানানো ঘন দুধের ঘিয়ে রঙ হ’য়ে যাওয়া কিশ্মিশ্ দেওয়া পায়েশ খেত। অনেক বাড়িতে দেখেছি সরস্বতী পূজায়
জোড়া ইলিশ দেয়। আমাদের বাড়ি নিরামিষ ছাড়া আর কিছু ঠাকুরের পায়ে দিতে দেখি নি।
সরস্বতীর চারপাশ সাজানোর
জন্য বন্ধুরা আমার সাথেই গাঁদাফুল আর ডালিয়া তুলত। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির
মাষ্টারমশাই-দের পকেটে খুব বেশি টাকা পয়সা না থাকলে কি হবে। বাগানে তাদের
সোনালি-হলুদ গাঁদা আর মেরুন রঙ্গের ডিনার প্লেট ডালিয়ার কোন অভাব কখনই ছিল না। আর
আমরা ‘হিন্দু বালিকারা’ তো পরীক্ষায়
ফেল করবার ভয়ে সরস্বতী পূজা্র আগে নারকেলী কুল খেতাম না। প্রাণের মুসলিম বন্ধুরা
এ বছরের কুলের কি স্বাদ তা বাজারে কুল ওঠামাত্র গল্প করেই বুঝিয়ে দিত।
বিজয়া দশমীর নারকেলের নাড়ু
আর ক্ষীরের সন্দেশ আমার দিদা কোনদিন শুধু হিন্দুদের জন্য বানায়নি। আমরাও নিজেদের
ভাই ছিল না ব’লে ভাই ফোঁটাতে ক্যাম্পাসের মুসলিম ছেলেদের ফোঁটা
দিয়েই বড় হয়েছি।
আমরা দুই বোন ছেলেবেলায় প্রত্যেক ঈদে নতুন জামা পেতাম। দিদা বানিয়ে দিত। সকালবেলা গন্ধ ভুর ভুর সাবান মেখে স্নান ক'রে, নতুন জামা পড়ে ঈদের নামাজ শেষ হ’লেই একের পর এক মুসলিম বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম সেমাই খেয়ে। পোলাও, রোষ্ট, কোর্মা, রেজালা, শামী কাবাব, জাফরান আর কমলা লেবু দেওয়া জরদার স্বাদ আজো জিভে লেগে আছে।
আমরা দুই বোন ছেলেবেলায় প্রত্যেক ঈদে নতুন জামা পেতাম। দিদা বানিয়ে দিত। সকালবেলা গন্ধ ভুর ভুর সাবান মেখে স্নান ক'রে, নতুন জামা পড়ে ঈদের নামাজ শেষ হ’লেই একের পর এক মুসলিম বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম সেমাই খেয়ে। পোলাও, রোষ্ট, কোর্মা, রেজালা, শামী কাবাব, জাফরান আর কমলা লেবু দেওয়া জরদার স্বাদ আজো জিভে লেগে আছে।
একবার তো চির উত্সাহী আমি
বন্ধুদের সাথে আরবী ক্লাশে বসে ‘ফাবি
আইয়ে আলাই রাব্বিকুমা তুকাজ্জীবান’, 'লা, ইলাহা, ইল্লা আনতা সুভহানাকা ইন্নাকুন্তুম মিনাজ জলেমীন' মুখস্থ ক’রে ফেললাম। আলিফ, বে, তে, সে-ও মুখস্থ একদম।
দাদু বাড়িতে একটা জায়নামাজ
সব সময় ঘরে রাখতেন। তাঁর চাকরি জীবনের সহকর্মীরা আমাদের মত ধর্ম কর্ম না মানা
উল্লুক তো আর ছিলেন না! তাই তারা যখন বাড়ীতে আসতেন, গল্প করতে
করতে মাগরীবের আজানের শব্দ শুনে জায়নামাজটি তাঁদের দিকে এগিয়ে দেওয়া হ’ত ঘরের পশ্চিম দিকে মুখ ক’রে।
মুসলিম বন্ধুদের বাড়ি থেকে
সব সময় আমাদের বাড়িতে কোরবানীর মাংস পাঠানো হ’ত। কিন্তু কেউ
কোনদিন ভুলেও গরুর মাংস পাঠানোর কথা ভাবতেন না। বেশির ভাগ বাড়িতেই খেয়াল ক’রে আমাদের জন্য খাসীর মাংস রান্না ক’রতে গিয়ে তা এক
হাতা দিয়ে নাড়া হ’ত, গরুর মাংস অন্য হাতা দিয়ে।
জীবনের বহু বছর কেটে গেছে
এইভাবে। আজ যখন ধর্ম, অধর্ম, সাম্প্রদায়িকতা, অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কথা ওঠে,
আমি সত্যিই কিছু লিখতে পারিনা। শুধু চোখের উপর একের পর এক এইসব ছবি
ভেসে ওঠে। চোখ জলে ভরে যায়। কলম পড়ে থাকে, তাতে কালি আর ভরা
হ’য়ে ওঠে না...
১৩ই মার্চ,২০০৩
স্টউটন, উইস্কনসিন
রূপকথা নয়
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে
যাব। সুপ্রিয় শিক্ষক গফ্ফার স্যার তাঁর প্রিয় ছাত্রীকে একপাশে ডেকে নিয়ে খুব নীচু
স্বরে জানালেন,‘যদি বোর্ডে ফার্স্ট হ’তে চাও,
যে সেকেন্ড হ’বে তার থেকে যেন কমপক্ষে ত্রিশ
নম্বর বেশি পেও। তা না হ’লে এক, দুই
নাম্বারের ডিফারেন্স থাকলে যখন একদম শেষে পরিক্ষাত্রীর সিরিয়াল নাম্বারের সাথে তোমার নাম মেলানো হ’বে, শুধু মাত্র হিন্দু নাম দেখেই তুমি সেকেন্ড হ’য়ে যাবে।’
মাঝে, মাঝেই দেখি গ্রাম থেকে আত্মীয় স্বজনের ১৫/১৬/১৮ বছরের মেয়ে এসে শহরের
আত্মীয় বাসায় থাকছে। ব্যাপার কি? না, উঠতি
বয়সের হিন্দু মেয়েদের আর গ্রামে রাখা যাচ্ছে না। তুলে নিয়ে যেতে পারে। তারচেয়ে
একটু নিরাপদে শহরে কিছুদিন থাকুক। বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত রাখতে পারলে আরো ভালো।
হিন্দু কারো ঢাকায় একটা
চারতলা বাড়ি করবার মত পয়সাপাতি হ’ল। চল্লিশবার ভাবনা। বাড়ি
করাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হ’বে? তার
চেয়ে যে দেশে
জন্ম সেই দেশেই শিকড়হীন হ'য়ে ভাড়া বাড়িতেই পুরোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া ভালো
নয় কি? ‘তুমি জামাই আদরে নিজের দেশে থাকতে পার, ছেলের অধিকারে থেক না।’
হিন্দু হয়ে পুলিশ, উকিল, ম্যাজিস্ট্রেট ইত্যাদি হওয়ার স্বপ্ন দেখা যেতে
পারে। কপালে থাকলে হ’বে। কিন্তু নিজ দেশে, দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নটা দেখলে কেমন হয়? ঘুমের
মধ্যেও মাথাটা পুরোপুরি খারাপ হ’য়ে গেছে নাকি? তোমার এ ঘুম যেন আর না ভাঙ্গে।
ক্লাশ ফোরে পড়ি। দুপুরবেলা।
হঠাত্ শুনি সদর দরজার কাছে খ্যাঁক, খ্যাঁক, খিক, খিক হাসি। সাধারণতঃ এই ধরণের
হাসি মানুষ হাসে যখন তারা অন্য মানুষের বুকের উপর দিয়ে চারটা চাকা চালিয়ে দেয়। হাসে
লিঞ্চিং-এর সময় কালো মানুষকে আমেরিকার দক্ষিণে গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে শাদারা। গ্যাস
চেম্বারে মানুষ ঢুকিয়ে দিয়ে হাসে নাজিরাও।
দিদা, দাদু, মা, মাসি,
মামা সবাই দরজার কাছে। যেন তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা গড়ে ফেলবে। সবাই আমাকে আর
আমার ছোট বোনকে সবসময়ের মত এবারও জগতের সব নীচতা থেকে আড়াল ক’রে রাখবেই রাখবে। কিন্তু
হায়! আমি তো জ্ঞান পিপাসু মাদাম কুরী। উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখি ড্রেন থেকে তুলে আনা একটা
কাদা মাটি মাখা কচ্ছপ নিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে আছে। আর মুচকি মুচকি কী বিকট যে হাসি। খবর
পেয়েছে হিন্দুরা কচ্ছপ খায়।
বিয়ের পর আমরা দু’টো কাছিম পুষতাম। নাম
ছিল টুড্ল আর টিডা। সকাল, বিকাল মাছের খাবার দিতাম। তা
ছাড়া অন্যান্য সময়ে সবুজ, লকলকে কলমিশাক। কী ভালোই যে বাসতাম ওদের। অসাধারণ দেখতে। আর এ কাজ ক’রে আমি আর আমার পতিদেবতা এতটাই
বিখ্যাত হ’য়েছিলাম যে প্রায় বিশ বছর পর আমাদের পরিচয়
নিশ্চিত করতে এখনও অনেকে বলে থাকে,‘ও যাদের বাড়িতে কচ্ছপ
ছিল?’ চিরদিন পশু পাখি কোলে ক’রে
ঘুরে বেড়ানো আমি কোন প্রাণীকে কষ্ট দেব না ব’লে বহু বছরের
চেষ্টায় তো আজ ‘ভীগান’ হ’য়ে গেছি। কচ্ছপ কেন আমি তো আজ রিফাইন্ড সুগার খাই না, মাছ খাই না, মাংস খাই না, ডিম খাই না, দুধ খাই না, মাখন খাই না, ঘি খাই না, কেক-বিস্কুট-কালোজাম-পান্তুয়া খাই না, মৌমাছির
কষ্ট হ'বে বলে মধু খাই না। শুধু অল্প কিছু ফল, পাতা, ফুল খেয়ে হিমালয়ের সন্ন্যাসী হ’য়ে কোনমতে বেঁচে আছি!
যাহোক অবান্তর, অপ্রাসঙ্গিক,
ফ্যাদরা প্যাচাল ছেড়ে ক্লাশ ফোরের বর্তমানে ফিরি। তাকিয়ে দেখি বাড়ির সকলের মুখ
অপমানে টক্টকে লাল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আমরা কি এতটাই ‘মালাউনের বাচ্চা’ যে নর্দমা থেকে তুলে আনা কচ্ছপ খেয়ে ফেলব?
আমরা কি এতটাই ‘মালাউনের বাচ্চা’ যে নর্দমা থেকে তুলে আনা কচ্ছপ খেয়ে ফেলব?
আমি আঠারো বছর বয়সে স্কলারশিপ
পেয়ে ইন্ডিয়া গেছি পড়াশোনা করতে। হিন্দু ব’লে স্কলারশিপের
কথা সু্যোগ পেলেই বলে ফেলি। পাছে কেউ না ভাবে মুসলিম বিয়ে ক’রে
বাড়ি থেকে পালাতে পারি ব’লে মেয়েকে প্যাকেট ক’রে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হ’ল।
কোলকাতায় একদিন দুপুরবেলা।
আলোচনা হচ্ছে রবিঠাকুরের ‘গোরা’-র মঞ্চায়ন দেখতে যাওয়া
নিয়ে। জাতপাত নিয়ে নানা কথা। কী অসম্ভব ভালো নাকি হয়েছে। তবে এও তো ঠিক কাগজে কলম ঘষলেই যেমন লেখক হওয়া
যায় না, ‘গোরা’ পড়লেই প্রাণের ভিতরের
শ্যাওলা পরা দেয়ালে আটকে পড়া কুয়ার জল মহাসমুদ্র হ’য়ে ওঠে
না।
হঠাত্ তড়িঘড়ি, ঝপাঝপ, ঠাসঠাস ঘরের ডানদিকের জানালাগুলো বন্ধ হওয়ার
শব্দ। আত্মীয় করছে।
‘কি হ’ল?’
‘না, ওই মুছলমানের বাচ্চাদের মুখ দেখতে চাই না।’
আমি তো ভ্যাঁবাচ্যাকা। ‘কোন বাচ্চা?’
‘ওই দেখ্ না। মিস্ত্রীগুলো
ঘর রং করছে। সব রাজাবাজার থেকে উঠে এসেছে। মুছলমানের বাচ্চা মিস্ত্রী ছাড়া আর কি হ’বে?’
‘সে কি? এমন ভয়ানক কথা কেন বলছ? বাংলাদেশে আমার সব বন্ধুই তো
মুসলিম।
বাংলাদেশে শুধু হিন্দুরা বাঙ্গালী নয়, সবাই
বাঙ্গালী। আর পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আমরা তো সবসময়ই ইউনিভার্সিটির বড় পুকুরটার
পাশে, বাঁধানো সিঁড়িতে বসে গান গেয়েছি ‘ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে,
হল কানায় কানায় কানাকানি এই পারে ওই পারে...।’ হাঁটুর বয়সী ভীষণ মিষ্টি ছোট মেয়েদের গরমকাল ব’লে
ন্যাড়া মাথা। কিন্তু সে মাথাতেই তারা বেলীফুলের মালা হেয়ারব্যান্ডের মত ক’রে পরে সেজেছে। শাদা শাড়ী, লাল পাড় পরনে। কপালে বড় ক’রে একটা লাল টিপ। কখনো সিঁদুরেরও। পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে সবাই মিলে একসাথে কতবার
যে গেয়েছি, ‘বৈশাখের
এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ...।’ আমার বহু মুসলিম বন্ধু 'গীতিবিতান' মাথার বালিশ ক'রে ঘুমায়।
‘জানিস্ কি কী
ফেলে এসেছি? শুধুমাত্র বাস্তুদেবতা নীলকন্ঠ-কে মাথায় ক'রে এক কাপড়ে পালিয়ে
এসেছি। জমি জমা, ভিটা মাটি সব ফেলে। সেই কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিনে শুরু হ’ল। সাত দিনে পাঁচ হাজার হিন্দু-কে মেরে ফেলল ওরা।’
রায়টের গন্ধে বাতাসে হাইস্যা, বটি দিয়ে কেটে ফেলা মানুষের শরীরের কালচে হ'য়ে যাওয়া রক্তের গন্ধ শুঁকি। আগুনে দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঘর। দেখতে পাই ছেলেবেলায় আত্মীয়ের প্রিয়তম বন্ধু সোলায়মানের সাথে ডাঙ্গা গুলি খেলতে গিয়ে কিভাবে গুলিটা গড়িয়ে গড়িয়ে আত্মীয়দের দীঘিটায় পড়ে গেল। সোলায়মান ছুটে গিয়ে কোনভাবে গুলিটা আত্মীয়ের হাতের মুঠোয় তুলে দিতে নিল। ততক্ষণে দিঘীটা সোলায়মানের আব্বার হ'য়ে গেছে।
রায়টের গন্ধে বাতাসে হাইস্যা, বটি দিয়ে কেটে ফেলা মানুষের শরীরের কালচে হ'য়ে যাওয়া রক্তের গন্ধ শুঁকি। আগুনে দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঘর। দেখতে পাই ছেলেবেলায় আত্মীয়ের প্রিয়তম বন্ধু সোলায়মানের সাথে ডাঙ্গা গুলি খেলতে গিয়ে কিভাবে গুলিটা গড়িয়ে গড়িয়ে আত্মীয়দের দীঘিটায় পড়ে গেল। সোলায়মান ছুটে গিয়ে কোনভাবে গুলিটা আত্মীয়ের হাতের মুঠোয় তুলে দিতে নিল। ততক্ষণে দিঘীটা সোলায়মানের আব্বার হ'য়ে গেছে।
আজো কিছুই ভুলতে পারছ না?
হাতদু'টো
ধরলেই পিঁয়াজের গন্ধ লেগে যাবে?
গলা জড়িয়ে ধরলে পৈতাটা
ছুঁয়ে দেবে?
দাঁড়িপাল্লায় লবণ আর জল
মেপে বাকি জীবনটা কেটে যাবে। মানুষের বেদনার ইতিহাস
প্রতিশোধের গল্প।
৩১শে মার্চ, ২০১৪
ম্যাডিসন, উইস্কনসিন
এসবই আমাদের মানবিকতার অবজ্ঞা-অবহেলা আর লজ্জ্বা !!!!
উত্তরমুছুনরমার মনটা এত নরম। এত সংবেদনশীল। লেখা পড়ে কষ্ট হয়। চাই খুব যে মানবতার জয় হয়। সবাই ভালবাসে সবাইকে। ঘৃণা স্থান না পায় মনে একটুও।
উত্তরমুছুনরমা, এভাবেই আমাদের জীবনের songs of innocence পালটে songs of experience হয়ে যায়! আমাদের বাস্তবতার গল্পগুলো তুমি এমনি করেই স্বাভাবিক দক্ষতায় বলে যাও- আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। তুমি এরকমই থেকো, এমন করেই লিখো।
উত্তরমুছুনরানা আপা
Rama,
উত্তরমুছুনBhalo thak.
Khub bhalo likhechish. Pore Rup kotha-i mone hochche.
Shusmi
অপুর্ব অসাধারণ - মনের মধ্যে মোচড় দেয় আবার ভাললাগার তুলি বুলিয়ে যায়। missed you Rama. keep on writing and enriching us
উত্তরমুছুনমানব সমাজকে মানবিক হয়ে উঠতে আরো কত সহস্র বছর অপেক্ষা করতে হবে কে জানে ! তবে আমাদের জীবনের এই ক্ষুদ্র পরিসরে এরকম "রক্তের ভিতর মিশে থাকা অস্তিত্বের গল্প" যেন বেশী বেশী শুনতে পাই সেই অপেক্ষায় রইলাম। শাওন
উত্তরমুছুনValo laglo, Rama. Mormo chhuye jaoa lekha. Likhe jaben. Shubhokamona
উত্তরমুছুনMasud Khan
শিলাময় ঠাণ্ডায়-ও জমে না চোখের জল
উত্তরমুছুনপানির নিয়ম ভেঙে গড়িয়ে উজানে উঠে যায় সে
বঙ্গোপসারে ভেজা মাটি থেকে উইস্কনসিনে
ভারি হতে হতে পারদ হয়ে যায়
নিমিশেই মেপে ফেলা যায় বুকের ভেতর গনগণে জ্বর
এত ভার সইবে না মন, ও দিদি
একবার বল ‘ওরে মোছোলমানের ছাও!
দ্যাখ আমি নাচি কেমন
বরফের ওপর তাক ধিনা ধিন ধিন
তাক ধিনা ধিন ধিন,তাক ধিনা ধিন ধিন
তাক ধিনা ধিন ধিন,তাক ধিনা ধিন ধিন
তাক ধিনা ধিন ধিন,তাক ধিনা ধিন ধিন
(নিশ্চয় ইহা কবিতা নয়, দেশে থাকলে বোতল নিয়ে আপনার কাছে যেতাম- গলা মেলাতাম- তাক ধিনা ধিন ধিন,তাক ধিনা ধিন ধিনতাক ধিনা ধিন ধিন,তাক ধিনা ধিন ধিনতাক ধিনা ধিন ধিন,তাক ধিনা ধিন ধিন)
তোমার ভাষিক ভঙ্গী টাও একান্ত তোমার! ধর্মীয় সম্পৃক্তি কিংবা সম্প্রীতির কথা গুলো আমাকেও জাগিয়ে দেয় ! আমরা চাটগার হিন্দু মুসলিম আর অবাঙ্গালীদের এক বিশাল কমিউনিটিতে ছিলাম ! সেই সময়ের ৬৫, ৬৭, ৬৯ সালের সর্ব ধর্মের কি মহিমা নিয়ে গেলে বিশাল উপখ্যান হয়ে যাবে ! কিন্তু একটা কথা এখানে অবতাড়না ন আ করে পারছি না ! বহু দিন আগে কুতুব্দিয়ায় ইন্টারভিয়ু নিতে গিয়ে ছিলাম আমার এক বন্ধুর ( পরবর্তিতে আমার স্ত্রী হলেন ) সাথে প্রবীণ আর প্রবীণাদের যারা বলতে পারবেন কি করে তাঁরা সেই যুগে কখন গণ মাধ্যম আজকের মতন এত সুদূরপ্রসারী ছিল না! কি করে তাঁরা মুসলিম লীগ আর কগ্রেস কে চিনলো এই দুরতম গঞ্জে ! কি করে এই ভাগের জন্ম নিল ! ১০০ বছরের বৃদ্ধা বললেন , কি জানি বাবা আমরা হিন্দু মুসলমান এক থালা থেকে খেতাম , কি করে যে জুদা হইলাম জানি না !
উত্তরমুছুনরমা, বড় খাঁটি কথা লিখেছ, মন ভরে গেল.! এই সব মানুষে মানুষে বিভেদ যে কত রাজনৈতিক এবং সঙ্কীর্ণ চাল, বুঝতে বুঝতে এক জন্ম কেটে যায়. ! আমরা ১৯৪৭ পরবর্তী কালের বাঙালি, , আমাদের দেশ ছিল চট্টগ্রামে, পরিবারের অনেকেই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, এটা সত্য যে সবকিছু ফেলে আমাদের পরিবার কলকাতায় চলে আসেন.দেশ ভাগের পর.... আমরা এই ধর্ম ভিত্তিক আক্রোশ নিজের চোখে দেখিনি, কিন্তু প্রেজুডিস শুনে শুনে বড় হয়েছি..... অনেকটাই তা onesided , পরে নিজের বোধ বুদ্ধি হবার পর বুঝলাম অনেকটাই তা মূল আর্থিক কারণ বশতঃ, বাস্তুচ্যূত হবার জন্য ক্ষোভ, যা এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘনীভুত হয়েছিল.... যে আক্রোশ রাজনৈতিক নেতা ও নীতির বিরুদ্ধে হবার ছিল তা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে হয়ে দাঁড়ালো....
উত্তরমুছুনAmaar khub ghonishto bondhu'r madhyame majhe majhe tomaar ashadharon kolomer resh pai. Bibhajoner itihash amader poribareo. Chattogram, Sylhet, Dhaka. Ekhon mone hoy koto jug agey. Kintu, theke theke bartoman tule dhore manusher amanushikota. Tokhon ma-baba'r kachhey shona kotha phirey ashey.
উত্তরমুছুনসাম্প্রদায়িকতা, এটাও এক ধরণের রোগ। খুব কম লোকেরই এর টিকা নেয়া আছে। কিছু লোকের এ রোগ মজ্জাগত, আবার কেউ কেউ সিজোনালী এ রোগে ভুগে। জানিনা কোনো দিন এর কোনো ওষুধ তৈরী হবে কি না?
উত্তরমুছুন